ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ২১:১০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

ঢাকার দিনরাত

নগর নির্বিকার। প্রতিদিন কত শিশু জন্ম নিচ্ছে, প্রতিদিন কত মানুষের চিরপ্রস্থান ঘটছে। উড়োজাহাজে চড়লে ওপর দেখে নগর অবলোকন করে ভাল লাগে। চেনা শহরকে অচেনা লাগে। তবে তাতে কোন বিশেষ পরিবর্তনও নজরে পড়ে না। নাগরিক বৃহত্তর জীবনও প্রায় একই রকম, কোথাও নিস্তরঙ্গ, কোথাও কোলাহল। পৌনে দুই কোটি মানুষ একেকজন একেকটা বিশ্ব যেন। একের গভীর ভেতরের খোঁজ তার অতি নিকটজনও অনেক সময় পান না। মানুষ কোন না কোন কর্ম নিয়ে বাঁচে, বাঁচে আশা নিয়ে। কোন কর্মস্থল বন্ধ হয়ে যায়, এও এক ধরনের মৃত্যুই। আবার জন্ম নেয় নতুন প্রতিষ্ঠান। চোখের সামনেই দেখলাম কত সংবাদপত্র হারিয়ে গেল। আবার জন্মগ্রহণও করল কত নতুন কাগজ। আর এখন তো অনলাইনের যুগ। অনলাইন মাল্টিমিডিয়া পোর্টালের জন্ম হচ্ছে এই করোনাকালেও। ছাপা কাগজের স্থান নিয়ে নিচ্ছে মোবাইলের পর্দায় ভেসে ওঠা সংবাদ। বিদায় ও নবজন্ম এবং নবায়ন- এসব মিলিয়েই জীবন সতত প্রবহমান। বাসা বদল অনেক ধকল বাসা বদল যারা করেন, আরও স্পষ্ট করে বললে কয়েক বছর পর পরই যাদের বাধ্য হয়ে নতুন ভাড়া বাসা খুঁজতে হয়, তারা জানেন এ কত বিড়ম্বনার এবং শারীরিক পরিশ্রমের, মানসিক পীড়নের। স্কয়ার ফিট হিসাবের মহানগরীর ফ্ল্যাটগুলোর মালিকদের অধিকাংশেরই মনমানসিকতা ওই স্কয়ারফিটের মতো কোন না কোন সীমাবদ্ধতার ভেতরেই আটকে পড়া। ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারেও কি একই কথা বলা যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে। সে যাক, বাসা বদল নিয়ে পাঠকের সঙ্গে একটি কবিতার কিছু অংশ শেয়ার করে মূল কথায় ফিরছি। সকল বদল নয় মিহি সুখকর তার একেকটি বাঁকে থাকে চোরাবালি বাঁকা জল বাসার বদল মানে খানিকটা জীবন বদল পরিবর্তনের ভাঁজে গুনগুন হারানোর অনুভব বাসার নিজস্ব ভাষা জন্ম নেয়, আশা থাকে তাতে পায় না কেরানি তার খোঁজ- সে চেনে বিছানা রুদ্ধশ্বাস পরাজয়ের ভেতর তবু মাথা তোলে বাসনার ভাষা হঠাৎ হঠাৎ, ভাসে স্বপ্নের সাম্পান অন্যদিকে প্রতিবেশি ভিনগ্রহবাসী, চিরআগন্তুক; পরিত্যক্ত ব্লেজার, বাতিল মেমো, এমনকি ব্যবহৃত শিশি সব কিছু ফিরেছে এ-ঠিকানার করুণ কামরায় কেবল ফেরেনি কিছু সত্য, অলৌকিক মুদ্রা, অলেখা কবিতা নতুন ঘরের মেঝেয় কেউ খোঁড়ে অদৃশ্য কবর পুরনো বাসায় কেউ ফেলে আসে প্রেম, জীবিত শেকড়। মানুষ বাসাবদলের ঝক্কি আর ধকলের কথা বলেন। কবিই বোঝেন মনোজগতে কী টানাপোড়েন চলে এই বাসাবদল কালে। বাস্তব অভিজ্ঞতার কথায় আসি। এখন ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানই রয়েছে যারা আপনার বাসার মালামাল সব প্যাক করে গুছিয়ে ট্রাকে তুলে নতুন বাসায় পৌঁছে দেবে। তবে কোন গৃহিণীই চান না তার ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্রে অন্যের হাত লাগুক। যাহোক, সংসারের সব কিছু ভাঁজ করে গুটিয়ে নিয়ে নতুন আবাসস্থলে গিয়ে সব কিছু আবার আনলোড করা। অনেক কষ্টের কাজ। কিন্তু এরপরের কাজটি মানে নতুন ঘরে নতুন করে সবকিছু সাজানোর কাজটি আনন্দময় হলেও পরিশ্রমের, অনেকটা সময়ও লেগে যায়। নতুন আসবাবপত্র বানানোর প্রয়োজন পড়ে। বিদ্যুতের সংযোগ, টিউব লাইট নতুন করে লাগানো, গ্যাসের চুলা যথযথভাবে লাগানো, ইন্টারনেটের লাইন টানা। কম্পিউটার ইনস্টল করা, অজ¯্র কাজ। কাজ শেষে এসি এবং বিদ্যুতকর্মীদের ছুটি দেয়ার পর যদি দেখা যায় একটি সিলিং ফ্যান শব্দ করে থেমে গেল, কোথাও পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে, তাহলে একটা আতঙ্কও কাজ করে। কেননা এই বাসায় আপনি একেবারে আগন্তুক। প্রথম রাতযাপন করছেন। গভীর রাতে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। চোখে প্রচ- ঘুম, কিন্তু বাইরে গাড়ির শব্দে ঘুম হারাম হয়ে গেল। আগের বাসায় তো এমন দশা ছিল না! ধীরে ধীরে আপনি বুঝবেন ভাল-মন্দের হিসাব। ফ্ল্যাটবাড়িতে কাপড় শুকানোর জায়গাটিও বুঝেশুনে নির্ধারণ করা লাগে। ফুলের টব কোথায় বসবে, কমোডের শেপ কি সাবেক ধরনের নাকি আধুনিক! বসে অস্বস্তি বোধ হয় কিনা। এক শ’ একটা সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াবে, প্রতিটির সমাধান না করে নতুন বাসায় আপনি থিতু হতে পারবেন না। আর খরচের কথা নাই বা তুললাম। বাসা বদল মানে শুধু এই বদলিজনিত বিশেষ ব্যয় রয়েছে। সেটিও কিন্তু একবারে কম নয়। সব মিলিয়ে মানুষকে বাসা পাল্টাতে হয়। আর যারা দেশ ছেড়েই চলে যান তাদের মনের অবস্থা একটু অনুমান করুন তো! ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি বাংলাদেশ বেতারে মহানগর নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় সকালে। ঢাকা বিষয়ক কলাম লিখি বলে কর্তৃপক্ষ অনেক কাল যাবতই অনিয়মিতভাবে আমন্ত্রণ জানান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে পা-ুলিপি লেখার জন্য। শত ব্যস্ততার মাঝেও বেতার কর্তৃপক্ষ চাইলে ওদের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করি। পূর্বতন কর্মকর্তা একদিন বলেছিলেন বাস্তব সমস্যার কথা। এখন সবার টিভির দিকেই ঝোঁক। আমি যেহেতু টিভি অনুষ্ঠানও করে থাকি, তাই তারা যেন না ভাবেন যে বেতার আমার কাছে কম গুরুত্বের। বলা যায় সে কারণেই বেতারের ডাক পড়লে আমি সাগ্রহে সাড়া দিই। রুটিন পদোন্নতি ও বদলের কারণে ইতোমধ্যে বেশ ক’জন অফিসারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। চলতি মাস থেকে আবার নতুন কর্মকর্তা দায়িত্বে এলেন। তিনি ফোনে বললেন, বাকরখানি খেতে খুব পছন্দ করি কিন্তু এর নেপথ্যে সুন্দর ইতিহাস রয়েছে সেটি জানি ভাসাভাসা। নিশ্চয়ই আমাদের বহু শ্রোতাই এ বিষয়ে আগ্রহী হবেন। তাই আপনার কাছ থেকে বাকরখানি নিয়ে একটি লেখা চাই। পরে নিচের লেখাটি ইমেলে পাঠিয়ে দিলে তিনি মেইলের জবাব মেইলে না দিয়ে সরাসরি নিজের মোবাইল থেকে ফোন করে বিশেষ ধন্যবাদ জানালেন। তার মতে এত তথ্য এত ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না। সাধারণত আমি এই কলামে এজাতীয় লেখা তেমন দিই না। কিন্তু এবার মনে হলো মাঝেমধ্যে দেয়াই যেতে পারে। তাই বাকরখানি নিয়ে যৎসামান্য। গোলাকার নোনতা স্বাদের মচমচে মজাদার খাদ্যবস্তু বাকরখানির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক সুপ্রাচীন। বলাবাহুল্য একটি নগরীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভেতর নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাস এবং প্রিয় খাবারও গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে থাকে। ঢাকার খাবারদাবারের ঐতিহ্য আর ইতিহাস বহু পুরনো। এখনও সেই খাবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার প্রতিটি বিখ্যাত খাদ্যের পেছনে লুকিয়ে থাকে যেন নবাবদের ঐতিহ্যের ইতিকথা। এমনই মির্জা আগা বাকির খাঁর প্রেমকাহিনী থেকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রুটি বাকরখানির নামকরণ করা হয়েছে। লালবাগের স্থায়ী বাসিন্দারা বাকরখানির কথা এভাবে ব্যক্ত করেন: আমাগো সকালের নাশতায় অথবা বিকেলে এক কাপ চায়ের লগে বাকরখানি খাওয়াই লাগে। এইডা ছাড়া আমাগো চলে না মনে কইরা নেন। কথিত আছে বাকরখানি রুটির নামের পেছনে রয়েছে আগা বাকের ও খনি বেগমের প্রেমের ইতিহাস। মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটির প্রচলন করেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খঁাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায়ও ছিলেন পারদর্শী ও প্রসিদ্ধ। বাকেরের প্রেয়সী ছিলেন রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম। খনি বেগমের মৃত্যুর পর আগা বাকের দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু আগা বাকের মন থেকে খনি বেগমের প্রেমের স্মৃতি ভুলতে পারেননি। তাই আগা বাকেরের আবিষ্কৃত রুটির নাম হয়ে যায় বাকরখানি। বাকরখানি তৈরির জন্য তেল, ময়দা, লবণ আর পানি ছাড়া তেমন কিছুই লাগে না। তবে, বাকরখানি বানানোর আলাদা ময়দা পাওয়া যায় শুধু চকবাজারে। শুরুতে নোনতা স্বাদের বাকরখানির কথা বলা হলেও অনেকেই আবার পছন্দ করেন মিষ্টি বাকরখানি। তাতে লবণের পরিবর্তে মেশানো থাকে চিনি। ঢাকার প্রায় অনেক জায়গাতেই বর্তমানে বাকরখানি পাওয়া গেলেও পুরান ঢাকার লালবাগ আর নারিন্দা এলাকায় সবচেয়ে পুরনো, সুস্বাদু ও বিখ্যাত বাকরখানি পাওয়া যায়। স্যান্ডউইচ, রোল, বার্গার, প্যাটিস, পিজ্জা-ফাস্টফুড খাবারের রমরমা এই সময়েও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি। আজকের আধুনিক উচ্চবিত্ত ঢাকাবাসী যদি কফির পেয়ালার সঙ্গে কুকিজ হিসেবে বিদেশী বিস্কুটের বদলে একখানা বাকরখানি প্লেটে তুলে নেন, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভাল খবর মন ভাল করে দেয় আমরা কি সবসময় খারাপ খবরের সঙ্গেই থাকি? তা নয়, ভাল খবর, তা একান্ত ব্যক্তিগত না হলেও, অন্যের জন্যে স্বস্তিকর খবরও আমাদের মন ভাল করে দেয়। ইট-কাঠ-কংক্রিটের পাষাণ নগরীতে এমন খবর আমাদের আশ্বস্ত করে। এই যেমন সেদিন পড়লাম অগ্নিদগ্ধ ৩ শ্রমিককে দেড় লাখ টাকা সহায়তাদানের খবরটি। গাজীপুরের টঙ্গী এবং রাজধানীর শ্যামপুর বাগিচা এলাকার দুটি কারখানায় অগ্নিদগ্ধ তিন শ্রমিকের স্বজনদের অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে। তাদের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়েছে। বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের পক্ষে মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিটিউটে চিকিৎসাধীন শ্রমিকদের দেখতে যান। সেখানে তাদের স্বজন এবং দায়িত্বে থাকা চিকিৎকদের কাছে শ্রমিকদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন এবং অর্থ সহায়তা দেন। বেশি আগে নয়, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি স্টিল মিলে গলিত লোহা ছিটকে ৫ জন শ্রমিক মারাত্মক দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত ৪ জন শ্রমিক মারা যান। কন্যাদিবস সোশ্যাল মিডিয়ার সংস্কৃতিতে পারিবারিক নানা দিবস নিয়েই মহাড়ম্বর চোখে পড়ে। সেদিন গেল কন্যাদিবস, কন্যা সন্তানকে আমাদের সমাজে মেয়েশিশু হিসেবে আখ্যায়িত করার চল দেখি। তবে কন্যা সন্তান দিবসে মা-মেয়ের তুলনায় বেশি পোস্ট চোখে পড়ে বাবার সঙ্গে মেয়ের। সে যাই হোক, মাতামাতি চলে মধ্যবিত্ত পরিবারেই বেশি। সেলিব্রেটিরা কন্যার ছবি পোস্ট করেন, আদিখ্যেতা দেখান। সাধারণ মানুষও কম যান না। কন্যাদিবসে কন্যাদের পাশে নেই বহু মা কিংবা বাবা, তবে ভৌগোলিক দূরত্বের সঙ্গে মনের নৈকট্যের কোন সম্পর্ক নেই। মা যেখানেই থাকুন, কন্যার সঙ্গে তার বন্ধন অটুট অদৃশ্য, সকল দূরত্বের উর্ধে। যে নারীটি তার মায়ের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত আচরণ করছেন, তিনিই আবার নিজ কন্যার সঙ্গে বাড়াবাড়ি ধরনের আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন। তখন তার কি একবারও মনে পড়ে তারও সঙ্গে মা-জননী একই ধরনের খুনসুটি ও আদিখ্যেতা করতেন এককালে? জানি না। কন্যাদিবস আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না যারা অন্তত একবার হলেও সারাদিনে ফেসবুকে ঢুঁ মারি। এবার বিশেষ করে সেইসব বাবার কথা এক মুহূর্ত ভাবলাম, যাদের কন্যারা কয়েকদিনের মধ্যেই কন্যা সন্তান জন্ম দিতে চলেছেন। ভালই তো, মেয়ে আর নাতনি-দুই কন্যার সঙ্গে নানা আয়োজনে আনন্দে মেতে ওঠা জীবনেরই অংশ। তবে সার্বিকভাবে সমাজে কন্যাদের জন্য পুত্ররা যেন প্রতিপক্ষ না হয়ে সহযোগী ও বান্ধব হয়ে ওঠে সেটিই বেশি করে কামনা করছি। সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ [email protected]
×