ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকারের ক্ষতি হবে প্রায় ১১ কোটি টাকা

রূপপুর আবাসন প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে অস্বাভাবিক দামে

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

রূপপুর আবাসন প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে অস্বাভাবিক দামে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আলোচিত বালিশকাণ্ডের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পে আবারও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে আবাসিক প্রকল্পে আবারও অস্বাভাবিক দামে আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে আসবাব কেনার কাজ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পের কর্মকর্তাদের আবাসিক প্রকল্প গ্রিন সিটির দশটি ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য চলতি বছরের ১৯ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেখানে আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছ থেকে আসবাব কেনা হচ্ছে। এতে সরকারের ক্ষতি হবে প্রায় ১১ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল পারটেক্স ফার্নিচার। তারা ৪৪ কোটি ৯২ লাখ ৪৭ হাজার টাকার দরপত্র জমা দেয়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন সাজিন কনস্ট্র্রাকশন দর দিয়েছিল ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ১২ হাজার টাকা এবং তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হাতিল দর দিয়েছিল ৫৫ কোটি ৯০ লাখ ৪৫ হাজার ৪১৯ টাকা। এছাড়া দরপত্র জমা দিয়েছিল এস রহমান এ্যান্ড ব্রাদার্স, ব্রাদার্স ফার্নিচার লিমিটেড ও আকতার ফার্নিচার লিমিটেড। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা পারটেক্স ফার্নিচার কাজ পাওয়ার কথা থাকলেও কাজ দেয়া হয়েছে হাতিল ফার্নিচারকে। নিয়ম না মেনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়ার ফলে এ খাতে সরকারের ক্ষতি হবে ১১ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে কেন সর্বোচ্চ দরদাতার কাছ থেকে আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে জানতে চাইলে পাবনা গণপূর্ত বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী ও টেন্ডার কমিটির চেয়ারপার্সন এবং প্রকল্প পরিচালক আরিফুজ্জামান খন্দকার বলেন, ‘এই দরপত্র নিয়ম মেনেই সম্পন্ন করা হয়েছে। কোন ধরনের অনিয়ম হয়নি। এরপর তিনি আর এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলা মোঃ আশরাফুল আলম বলেন, ‘আসবাবপত্র ক্রয়ে যদি কোন ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রূপপুর প্রকল্পের গোটা ক্রয় প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ, এখন আইএমইডি সেই কথাই বলছে।’ তার মতে, রূপপুর প্রকল্পের ক্রয়প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত, সরকারের উচিত তাদের সবাইকে কড়া জবাবদিহির আওতায় আনা। একই সঙ্গে দ্রুত স্বচ্ছ ক্রয়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব কেনাকাটা করা উচিত।’ এর আগে রূপপুর প্রকল্পে কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার অনিয়ম হয়েছে পদে পদে। সেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয় ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয় ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয় ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। ৩০টি চাদর আনতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়। আর ভবনের নিচ থেকে খাট পর্যন্ত তুলতে প্রতিটি চাদরের জন্য মজুরি দেখানো হয় ৯৩১ টাকা। এ দুর্নীতির ঘটনায় মামলা করে দুদক। গ্রেফতার হন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ১৩ জন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাবনা ও রাজশাহীর পূর্ত বিভাগের ৩৪ জন প্রকৌশলী অস্বাভাবিক এ কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দুটি প্রতিবেদন এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে এই অনিয়মের জন্য ৩৪ জন কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়। আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মোঃ ফয়েজউল্লাহ রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে দেয়া প্রতিবেদনে বলেছেন, রূপপুর প্রকল্পের মোট ক্রয় পরিকল্পনায় ত্রুটি রয়েছে। কেনাকাটায় একাধিক পদ্ধতি ও দরপত্র আহ্বানের মধ্যে এই ত্রুটি রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সইয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্প কবে শেষ হবে, তা একেক জায়গায় একেক রকম তথ্য রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ যেসব অবকাঠামো ও কেনাকাটা করবে, রাশিয়ার অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে তার সমন্বয় রেখে করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। সমন্বিত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা না থাকায় প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর অগ্রগতিও নিরূপণ করা যায়নি বলে প্রতিবেদন বলা হয়েছে।
×