ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

দুগ্ধ শিল্প সম্প্রসারণে রয়েছে অপার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ২২:৪০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

দুগ্ধ শিল্প সম্প্রসারণে রয়েছে অপার সম্ভাবনা

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুগ্ধ সামগ্রির চাহিদাও বাড়ছে কিন্তু সেই সঙ্গে উৎপাদন বাড়ছে না। সাম্প্রতিক এক তথ্যে দেখা যায় যে দেশে দুধের চাহিদা প্রায় ১৫০ কোটি টন কিন্তু অভ্যন্তরীণ দেশীয় খামারী ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে প্রতি বছর দুধ উৎপাদন হয় মাত্র ৬০ (ষাট) লাখ টন। ফলে চাহিদার অনুপাতে ঘাটতির পরিমাণ বছরান্তে দাঁড়ায় নব্বই (৯০) লাখ টন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতি বছর প্রায় এক হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকার গুঁড়ো দুধ আমদানি করতে হয়। অনেকে মনে করেন, যে পরিমাণ টাকা প্রতিবছর গুঁড়োদুধ আমদানিতে ব্যয় হয় তা যদি স্থানীয় দুগ্ধ উন্নয়নে ঋণ বা প্রণোদনা হিসেবে দেয়া যেত তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা হয়ে উঠছে না যে কারণে তা হলো এই আমদানি ব্যবসার সঙ্গে অনেক সুবিধাভোগী জড়িত রয়েছেন। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগানাইজেশন (WHO) মতে একজন মানুষের প্রতিদিন ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা প্রয়োজন অথচ সেখানে বাংলাদেশের মানুষের প্রাপ্তি মাত্র ৪০ মিলিলিটার। বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ অধিদফতরের (২০১৮-২০১৯) হিসাব মতে দুধের চাহিদা (জন প্রতি ২৫০ মিলিলিটার হিসাবে) ১৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন টন এবং একই সময়ে উৎপাদন হয় মাত্র ৬ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন যার ফলে ঘাটতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫১ মিলিয়ন টন। এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য আমদানি বাণিজ্যই একমাত্র অবলম্বন অথচ এই সকল গুঁড়ো দুধসহ অন্যান্য সামগ্রীর গুণগত বা পুষ্টিগত মান নিয়ে কেউ কিছু বলছে না যা জনসাধারণের স্বাস্থ্য চিন্তায় একটি ভাবনার বিষয়। তাই দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও দুধের বাজার সম্প্রসারণে এক অপার সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ সকল সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে না কেবল উদ্যোগের অভাবে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ঐতিহ্যগতভাবে দেশের কিছু কিছু অঞ্চল পূর্ব থেকেই দুধ উৎপাদনে অগ্রগামী ছিল এবং সে সকল দুধ স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে জেলা কিংবা জাতীয় পর্যায়ের বাজারগুলোতে ব্যবসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তখন ব্যবসায়ীগণও উদ্যোগী ছিল এবং পাবনার লাহিরি মোহনপুরে (বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা) ব্যক্তি মালিকানায় একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যার উৎপাদন সামগ্রী কলকাতার বাজারে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু ১৯৪৭ এ দেশ বিভক্তির পর কলকাতার বাজারটি বন্ধ হয়ে যায় আর ঢাকার বাজার তখন এতটা সংগঠিত ছিল না এবং এই প্রক্রিয়াজাত কারখানাটি আর স্থায়িত্ব পায়নি। তাই বলে প্রচেষ্টা বন্ধ থাকেনি এবং ১৯৬৬ সালের পর পাকিস্থান সরকার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান মিল্ক প্রডোওয়ার্স কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেড (এপকুল) নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল যার ব্রান্ড নাম গরষশ ঠরঃধ। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামাঞ্চলে যে সকল এলাকায় দুধের উৎপাদন ঐতিহ্যগতভাবে বেশি হয় সেগুলো সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে শহরাঞ্চলে বিশেষত ঢাকায় সরবরাহ করা। স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময়ের পথ পরিক্রমায় এই সংস্থাটি বর্তমানে চালিত থাকলেও এর মাধ্যমে ডেইরি উন্নয়ন তেমন সংগঠিত হয়ে উঠেনি কেবল মাত্র দক্ষ জনশক্তির অভাবে। বাজার এখন উদার এবং এই প্রতিযোগিতায় মিল্ক ভিটার দুগ্ধ সামগ্রী তেমনভাবে টিকে থাকতে পারছে বলে মনে হয় না। ফলে বছরান্তে কোটি কোটি টাকা সরকারকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অথচ সঠিকভাবে কাজটি সংগঠিত হলে এরই মধ্যে সারাদেশে মিল্ক ভিটা একটি দুগ্ধ বিপ্লব ঘটতে পারত। যে সমস্ত কারণগুলো এর মধ্যে রয়েছে তার গুরুত্বের ক্রমানুসারেÑ প্রথমত: বাংলাদেশে কোন নেতা জন্মায়নি যে তৃণমূল পর্যায়ে সমবায় সংগঠন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে সারাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে বিশেষত দুগ্ধ বিপ্লবে; দ্বিতীয়ত: সরকারী আমলাতন্ত্র যা অনেকাংশে ফাইলবন্দী নীতিতে বিশ্বাসী তারাই এটিকে নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে দেয় না আর তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সংগঠন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি যা দেশের সংগঠন নির্মাণের প্রথম অন্তরায় বলে বিবেচিত; তৃতীয়ত: স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের হাতে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব না দিয়ে সমবায় অধিদফতরের হাতে হওয়ায় বিপর্যয়ের মাত্রাটি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে; চতুর্থত: দুগ্ধ বিজ্ঞানে ডিগ্রীধারী জনবলের অপর্যাপ্ততা, কারিগরি অদক্ষতা, মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অনাগ্রহতা ইত্যাদি; পঞ্চমত: গো-খাদ্য, ঔষধপত্র, চিকিৎসা সেবা প্রভৃতির অপ্রতুলতা বিশেষত মিশ্র খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় আয়-ব্যয়ের হিসাবে দুগ্ধখামারীরা আর খরচ পুষিয়ে উঠতে পারছে না; ষষ্ঠত: গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের কৃষ্টি কিছু অঞ্চল ছাড়া সারাদেশে পরিলক্ষিত হয় না। যার ফলে বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজন যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত তারা Economics of scale এর সুযোগ থেকে প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছে; সর্বশেষ: পেশা হিসেবে দুগ্ধ ব্যবসা লাভজনক না হলেও এটিকে লাভের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে উদ্যোগ বিশেষক্ষেত্রে সরকারী প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণ, স্বাস্থ্য সেবা, গোখাদ্য উৎপাদনে পর্যাপ্ত জমি, গোচারণ ভূমি, ইত্যাদি তেমন দেখা যায় না। আবার দুধের উৎস হিসেবে ছাগল, মহিষ, প্রভৃতি পারিবারিক থেকে শুরু করে বাণিজ্যিকভাবে লালন পালনের কোন প্রকার প্রচার প্রচারণা সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে একেবারেই পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ পেশা হিসেবে অগ্রাধিকার পেলেও এ পেশায় সামাজিক স্বীকৃতি এখনও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় পুষ্টিমানের বিচারে দুগ্ধপণ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বাীকার্য হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এর স্ববিরতা কাটিয়ে ওঠার কোন প্রকার উৎসাহব্যঞ্জক চিত্র চোখে পড়ে না। এরই মধ্যে সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পতা (২০১৬-২০২০) প্রণয়ন করেছে এবং এই দলিলটির তথ্য মতে দেশের প্রাণী সম্পদের সংখ্যা যথাক্রমে গরু ২৩ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন, মহিষ ১ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন এবং ছাগল ২৫ দশমিক ৬০ মিলিয়ন। এই সকল প্রাণী থেকে বছরে দুধ উৎপাদন হয় ৬ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন যা দেশের মোট চাহিদার তুলনায় ৭ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ঘাটতি। এর প্রধান কারণ সরকারী বাজেটে অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও বেসরকারী খাতে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ ডায়েরি ফার্ম উদ্যোক্তার অভাব। দেশে বর্তমানে সরকারের পাশাপাশি আটটি কোম্পানি দুগ্ধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত যাদের পণ্য সামগ্রী মূলত তরল দুধ, মিল্ক পাউডার, ঘি, ছানা, পনির, বাটার ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। দেশীয় কোম্পানিগুলো মনে করে বর্তমানে প্রচলিত দেশীয় শিল্পনীতিকে সহায়তা দিলে দেশে গ্রামপর্যায়ে অবস্থিত দুগ্ধ খামারী ও শহর কেন্দ্রিক কোম্পানিগুলো তরল বা গুঁড়ো দুধের চাহিদা মেটাতে পারবে। আবার দুধ আমদানিতে বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তা যদি দেশী শিল্পে বিনিয়োগ করা যায় তবে ভারতের মতো বাংলাদেশও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশীয় দুধের বাজারের সিংহ ভাগ (৮০%) গুঁড়ো দুধের দখলে যার প্রায় বেশিরভাগ আমদানিকৃত। আবার বিশুদ্ধ খাদ্যের বিবেচনায় সম্পূরক শুল্ক উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে গুঁড়ো দুধ থেকে যার ফলশ্রুতিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না স্বদেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই পরিকল্পনা মেয়াদে বেশ কিছু কৌশল ও নীতিমালার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেমন: সম্প্রসারণ জোরদারকরণ, ডেইরী খাতে সমবায়ের অবস্থান জোরদার করণ, মাঠ গবেষণা শক্তিশালীকরণ, গবেষণা, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ঠবঃবৎরহবৎু সেবা বাড়ানো, গবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদন, ক্ষুদ্রকায় খামারিদের ঋণ সহায়তা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন গ্রামভিত্তিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতিগুলোকে জোরদারকরণ এবং মিল্ক ভিটার কার্যপরিধি বাস্তবভিত্তিক দুগ্ধ প্রাপ্তির মানদন্ডে সারাদেশে সম্প্রসারণ, রাজনৈতিক বিচেনায় নয়। সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উদ্যোক্তাকে এই কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে আসা সকল প্রণোদনা দিয়ে। কারন দুধ থেকে তৈরি বিভিন্ন দুগ্ধসামগ্রীর এক বিশাল বাজার সারাদেশে ছড়িয়ে আছে যার চাহিদা অফুরন্ত। তাই অগণিত কর্মহীনের কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, জি.ডি.পি প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই দুগ্ধশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে দেশে নতুন সাদা বিপ্লব (White revolution) সংগঠিত করতে আগামী দিনে এই অঙ্গীকার আমরা চাই।
×