ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খুন হওয়ার ৪৫ দিন পর অবশেষে ফিরে এলো দিশা মনি

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৫ আগস্ট ২০২০

খুন হওয়ার ৪৫ দিন পর অবশেষে ফিরে এলো দিশা মনি

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ ॥ দিশা মনি (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়া হয়েছে। এ হত্যার ঘটনায় তিন আসামি নারায়ণগঞ্জ আদালতে এমনই জবানবন্দী দিয়েছে। অথচ জবানবন্দীতে সেই খুন হওয়া ছাত্রী রবিবার ৪৫ দিন পর জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে। সোমবার দিশা মনি ফিরে আসার বিষয়টি পুলিশ স্বীকার করে। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সর্বত্র শুরু হয়েছে তোলপাড়। দিশা মনি নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। গত ৪ জুলাই থেকে সে নিখোঁজ ছিল। ঘটনার একমাস পর ৬ আগস্ট থানায় অপহরণ মামলা করেন শিশুটির বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। এ ঘটনায় তিন আসামি গ্রেফতারের পর আদালতে জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দী দেয়া ওই তিন আসামি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে আছে। দিশা মনি ফিরে আসার ঘটনায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মামলা দায়েরের পর এ ঘটনায় পুলিশের তদন্ত নিয়েও নানামুখী প্রশ্ন উঠেছে। আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়া সেই তিন আসামি নিরাপরাধ, না দোষী এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। এদিকে দিশা মনিকে জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়ে তার মা-বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনরা খুশিতে আত্মহারা হয়েছেন। অপরদিকে গ্রেফতারকৃত তিন আসামির স্বজনদের দাবি, পুলিশী নির্যাতনের মুখে তাদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা বলছেন, যেহেতু দিশা মনি হত্যা হয়নি। কিংবা তাকে নির্যাতনও করা হয়নি। সে অন্য এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। অথচ তাকে অপহরণের দায়ে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে পুলিশী নির্যাতনের মুখে তাদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। এ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির আসল বিষয়টি উদ্ঘাটনের জন্য জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলমের নির্দেশে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) জাহেদ পারভেজ চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মোঃ শালেহ উদ্দিন আহমেদ ও বিশেষ শাখার পরিদর্শক (ডিআই-ওয়ান) একেএমএস ইকবাল। দিশা মনির বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন মামলায় উল্লেখ করেন, আসামি আব্দুল্লাহ তার মেয়েকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে প্রেমের প্রস্তাব দিত। এতে বাধা দিলে মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেয়। ৪ জুলাই সন্ধ্যায় আব্দুল্লাহ ফোনে ঠিকানা দিলে তার মেয়ে সেই ঠিকানায় যায়। পরে তাকে অপহরণ করে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা। এরপর থেকেই তার মেয়ের কোন খোঁজ নেই। মামলার পরে মেয়েটির মায়ের মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করে রকিব নামে এক যুবকের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। রকিবের মোবাইল নম্বর দিয়ে আব্দুল্লাহ দিশার সঙ্গে যোগাযোগ করত। ঘটনার দিনও ওই নম্বর দিয়ে কল করে আব্দুল্লাহ। এ ঘটনায় মামলার পর রকিব, আব্দুল্লাহ ও খলিল নামে এক নৌকার মাঝিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৯ আগস্ট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পৃথক দুটি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয় আসামিরা। স্বীকারোক্তিতে তারা জানায়, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী দিশা মনিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ২৩ আগস্ট রবিবার সেই দিশা মনিকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পান তার বাবা-মা। বন্দরের নবীগঞ্জ এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে তার মা-বাবা দিশাকে উদ্ধার করে সদর থানায় নিয়ে এসে হস্তান্তর করলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দিশা মনির মা জানান, বন্দরের কুশিয়ারা এলাকায় ইকবাল নামে একটি ছেলের সঙ্গে গত দেড় মাস ছিল সে। দিশাকে বিয়ে করে তারা সেখানে বসবাস করছিল বলে জানান তিনি। এদিকে দিশা মনি জীবিত ফিরে আসার খবর পেয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়া গ্রেফতারকৃত তিন আসামির স্বজনরা থানার সামনে ভিড় করে। তারা এ সময় দাবি করে, গ্রেফতারকৃতরা নির্দোষ। গ্রেফতার আব্দুল্লাহর মা শিউলী আক্তার বলেন, আব্দুল্লাহ ওয়ার্কশপে কাজ করত। যদি আমার ছেলে কিছু করত তাহলে মেয়েটা জীবিত ফিরে আসলো কেমনে? আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। গ্রেফতারকৃত নৌকার মাঝি খলিলের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, সন্দেহ কইরা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। পরে পুলিশ বলছে, ওই মেয়েরে নাকি আমার স্বামী হত্যা করেছে। এখন ওই মেয়ে বেঁচে আছে। আমার স্বামীরে কেন পুলিশ ফাঁসিয়ে দিয়েছে জানতে চাই। আমি এ ঘটনার স্্্ষ্ঠুু তদন্ত ও বিচার চাই। নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, দিশা মনিকে ৪৫ দিন পর জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। দিশা মনি নিজে তার বাবা-মাকে ফোন করে টাকা চাইলে প্রথমে তার বাবা-মা প্রতারণা মনে করে পুলিশকে অবহিত করেন। পরে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে মামলার তদন্তকারী অফিসার বন্দর উপজেলা থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন। একইসঙ্গে দিশা মনি এতদিন যার সঙ্গে আত্মগোপনে ছিল সেই ইকবাল ওরফে ইব্রাহিমকে আটক করা হয়েছে। দিশা মনি ও ইকবাল থানা হেফাজতে রয়েছে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দিশা মনিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়ার কথা তিনজন আদালতে স্বীকারিক্তমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি বলেন, হয়ত আসামিরা আদালতে যে জবানবন্দী দিয়েছে সে অন্য কোন মেয়ে হতে পারে। এ বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বলেন, যেহেতু ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। আবার যেহেতু ভিকটিমও জীবিত ফিরে এসেছে। ভিকটিম (দিশা মনি) যার কাছে ছিল তাকেও আমরা নিয়ে এসেছি। যেহেতু আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তি জবানবন্দী দিয়েছে, তারা কি বলে জবানবন্দী দিলো, এ সকল বিষয়টি উদ্ঘাটনের জন্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) জাহেদ পারভেজ চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি আসামিদের নির্যাতন করে জবানবন্দী দিতে বাধ্য করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, এ বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামিদের স্বজনরা অভিযোগ দিলে তদন্ত করে যদি অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য দোষী হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×