ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র ঈদ-উল-আজহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত: ২১:০২, ৩১ জুলাই ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র ঈদ-উল-আজহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ঈদ-উল-আজহা আরবী উচ্চারণ ঈদ-উল-আদ্্হা অর্থাৎ যবেহ করার আনন্দ উৎসব। যবেহ বা কুরবানি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক প্রাচীন রীতি। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রথম কুরবানির ঘটনা ঘটেছিল হযরত আদম (আ.) এর সময়ে। আদম ও হাওয়া আলাইহাস সালামের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মধ্যে আক্রিমা নামে আদম-হাওয়ার এক কন্যাকে বিয়ে করা নিয়ে বিবাদ বেঁধে যায়। সেই বিবাদের কারণে কাবিল হাবিলকে হত্যা করে। এ হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকা-। কোরবানির সূত্র সেখানেই। প্রত্যেকটা জাতির মধ্যেই কোরবানির রীতি বর্তমান হয়ে যায়। ঈদুল আজহা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ) এর কোরবানির ঘটনা। হযরত ইসমাইল (আ) এর বয়স তখন ১০/১১ বছর। একদিন হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁর প্রিয়জনকে কোরবানি দিতে হবে। তিনি স্বপ্নে দেখে তাঁর পুত্রকে এসে বললেন বেটা, আমি আদিষ্ট হয়েছি কুরবানি দেবার। তাঁর এ কথা শুনে ইসমাইল (আ) বললেন : আব্বা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন সেটাই করুন। ইনশাল্লাহ, আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। হযরত ইবরাহীম (আ) পাঁচ মাইল দূরে মিনা নামক স্থানে পুত্রকে নিয়ে এসে তাকে শোয়ায়ে তাঁর গলায় ছুরি মারতে গেলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন, ইবরাহীম তুমি ক্ষান্ত হও। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। আল্লাহর নির্দেশে তিনি একটি দুম্বা কুরবানি দিলেন। বলা হয়েছে যে, এ দুম্বা বেহেশত থেকে আনা হয়েছে। সে থেকে প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য কুরবানি দেয়া ওয়াজিব। যদি গরু কিংবা উট হয় তবে সাতজন মিলে কুরবানি দেয়া যায়। কুরবানি শব্দটা এসেছে আরবী র্কুব থেকে। র্কুব অর্থ নৈকট্য, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই কুরবানি দিতে হয়। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছে যেসব ইসলামী উৎসব তার মধ্যে ঈদুল ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা প্রধান। এই দুটি পর্ব সমগ্র মুসলিম জাহানেরই জাতীয় আনন্দ-উৎসব। ঈদ-উল- ফিতর আত্মসংযম ও সমমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে আর ঈদ-উল-আজহা আত্মোৎসর্গের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় আরব দেশে ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সমসাময়িককালেই। প্রাচীনকালে বাংলাদেশের সঙ্গে আরব দেশের নৌপথে নিবিড় বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এই সুবাদেই আরব বণিকগণ হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের আমলেই বাংলাদেশে ইসলামের বার্তা বয়ে নিয়ে আসেন। এও জানা যায় যে, চীন ও সুমাত্রা অঞ্চলে নৌপথে বাণিজ্য জাহাজে গমনকারী কোন কোন সাহাবায়ে কেরাম সফর বিরতি করেছেন বাংলাদেশের উপকূলীয় সমুদ্র বন্দরে। তবে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচারের সূত্রপাত ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক রাদিআল্লাহু, তা’আলা আন্হুর খিলাফতকালে। ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের মননকে যে পরিচ্ছন্ন চেতনায় উদ্ভাসিত করে, যে প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে তা অতি দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে এ দেশের বৃহৎ অংশে। এদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বহুত্ববাদের দীর্ঘকালীন নিগড় থেকে নিজেদের মুক্ত করে একাত্ববাদের মুক্ত সড়কে এসে সত্যিকার জীবন জোয়ারে আপ্লুত হয়। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অচলায়তন। সত্য-সুন্দরের বুলন্দ আওয়াজে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ বাতাস। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আঙিনা ইসলামের ইমান-আকিদা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অনুশাসনের প্রভাবে- যা কালে কালে এদেশী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের স্বকীয় পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিপ্লবাত্মক প্রভাব ফেলে আসছে সেই আদিপর্ব থেকেই। ঈদ-উল-আজহা এমন এক আনন্দ-উৎসব যা শুধু জীবনকে জানবার এবং উপলদ্ধি করবার প্রেরণাই দান করে না, বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার নৈকট্য লাভের পথও প্রশস্ত করে দেয়। কোরবানির ঈদ বাংলাদেশে বক্রি ঈদ নামেও পরিচিত। আরবী বাকারা শব্দের অর্থ গাভী। কেন যে ঈদ-উল-আজহা বাংলাদেশে গরু কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত হলো সেটা সত্যিই ভাববার বিষয়। এর পেছনে এই দেশের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটও লুকিয়ে রয়েছে। এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলিম। তাদেরই চিন্তা-চেতনা, আনন্দ-আহ্লাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে সংস্থাপিত করেছে শক্ত বুনিয়াদের ওপর। কোরবানির সঙ্গে তাদের জাতীয় ঐতিহ্য, চেতনা এবং জাতীয় সংহতির সম্পর্ক গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু কোরবানি তো গরু ছাড়া ছাগল, ভেড়া, মহিষ দ্বারাও হতে পারে। সে সবের বদলে গরুকে ঘিরে এদেশে কোরবানির মূল প্রথা গড়ে উঠার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। এর একটি কারণ, এদেশে মহিষের তুলনায় গরুর সহজলভ্যতা, দ্বিতীয়ত, ছাগল বা ভেড়া মাত্র একজন লোক কোরবানি দিতে পারে। তার স্থানে গরু সাত জন মিলে দিতে পারে বলে তা তুলনামূলকভাবে সস্তাও হয়। বাংলাদেশে এসব বাস্তবতার নিরিখেই গো-কোরবানি অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। এদেশে ইসলামের আগমনের প্রথম পর্যায়ে থেকেই মুসলিম সমাজের ওপর আক্রমণ এসেছে কখনও পরোক্ষ কখনও প্রত্যক্ষভাবে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসব আগ্রাসন রুখে দাঁড়াতে মুসলমানরা তাদের স্বাতন্ত্র্য ও ঐক্য চেতনাকে জোরদার করেছে। সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি নির্মাণে সেসব উপাদান কাজ করেছে, যেসব উপাদান মুসলমানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রেরণা দান করেছে তার মধ্যে, কোরবানির ঈদ অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই ঈদ-উল- আজহার গরু কোরবানির ঈদ নামকরণ লাভ করে মুসলিম মননকে বিপ্লবী মহাসড়কে এক সুদৃঢ় ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে এবং তাদেরকে আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে বাংলার জমিনে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে। ঈদ-উল-আজহার নামকরণ গরু কোরবানির ঈদ যে কারণেই হোক না কেন, এর মধ্যে যে এক সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিহিত ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এদেশের মুসলমানদের আপন সত্তা বিকশিত করবার ক্ষেত্রে বকরা ঈদ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই পশু কোরবানির সময় মুসলিম উচ্চারণ করে আমার সালাত ও আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের জন্য। এই উচ্চারণ তাকে আল্লাহ্ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত না করতে সাহস জোগায়। তৌহীদের আসল অর্থ সে বুঝতে পারে, বার বার তার হৃদয়ের গভীর থেকেই উচ্চারিত হয় লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ। ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যে এর উপস্থিতি অবলোকন করলেই। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানরা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করে আসেন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই। ব্রিটিশ ভারতে আমরা কবি কায়কোবাদ, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী প্রমুখ কবির লেখায় আত্মকোরবানির প্রতীক রূপে কোরবানি ঈদকে দেখতে পাই। অনল প্রবাহের কবি ইসমাঈল হোসেন শিরাজী ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য নিজের জান কোরবানি দেবার শপথ গ্রহণ করতে জাতিকে আহ্বান জানান। বাংলা সাহিত্যে কোরবানির ঈদকে ব্যাপকভাবে এবং সঠিক পরিচয়ে উপস্থাপিত করেন আমাদের জাতীয় -কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কোরবানির ওপর তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেন। তিনি এক স্থানে বলেন, ডুবে ইসলাম আমে আধার/ইব্রাহীমের মতো আবার/ কোরবানি দাও প্রিয় বিভব/জবীহুল্লাহ ছেলেরা হোক...। ঈদ-উল-আজহা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এর আনন্দ এনে দিয়েছে সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংরক্ষণের অনুপ্রেরণা। কোরবানির পশুর গোশ্ত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া এবং আর এক ভাগ নিজের পরিবার পরিজনের জন্য, রাখা- এই বণ্টন নীতি, ঈদের আনন্দ সবাই সমানভাগে ভাগ করে নেবার প্রেরণায় উদ্ভাসিত করেছে। ঈদ-উল-আজহা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে এবং আত্মসচেতনতায় বলীয়ান করে। ঈদ-উল-আজহার দিনে সামর্থ্য মতো ভাল পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে, নিজেকে সুন্দর করে সজ্জিত করে ঈদগাহে গিয়ে বৃহৎ জামাতে দুই রাক’আত নামাজ ইমামের পেছনে আদায় করবার মধ্যে, নামাজ শেষে ধনী, নির্ধন একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলির মধ্যে, তারপর যাদের সামর্থ্য আছে তাদের পশু কোরবানির মধ্যে, কোরবানির গোশ্ত ধনী, নির্ধন সবার মাঝে বণ্টনের মধ্যে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে- তা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এক মিলন মোহনায় এসে দাঁড়াবার প্রেরণা জোগায়। ঈদ-উল-আজহা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এনে দেয় মহামিলনের অনুভব। লেখক : পীরসাহেব, দরিয়াপুর দরবার শরিফ
×