ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় ফতেহ আলী (র) মাজার ও আনন্দময়ী কালীমন্দির পাশাপাশি

প্রকাশিত: ১৯:২১, ২৫ জুলাই ২০২০

বগুড়ায় ফতেহ আলী (র) মাজার ও আনন্দময়ী কালীমন্দির পাশাপাশি

সমুদ্র হক ॥ বহুকাল ধরে বগুড়া নগরীতে সম্প্রীতির বন্ধনে গৌরবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একদিকে ইসলামী সুফি সাধক ফতেহ আলী (র) মাজার শরিফ। তার পাশেই দশ মিটার পরই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আনন্দময়ী মন্দিরের অবস্থান। দুই অবকাঠামোর মধ্যের সরু পথ দিয়ে নিত্যদিন হাজারো মানুষ প্রবেশ করে শহরের নিত্যপণ্যের বাজারে। এই বাজারের নাম ফতেহ আলী বাজার। পূর্বদিকেই করতোয়া নদীর ওপর পূর্ব বগুড়ার সঙ্গে সংযোগ রক্ষার কংক্রিটের সেতু। কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে উত্তরে প্রায় দুই শ’ মিটার এগোলেই চোখে পড়বে ওই সম্প্রীতির নিদর্শন। যা কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। প্রতিদিন মাজারের আরেক ধারে মসজিদের মাইকে শোনা যায় আজানের ধ্বনি। সন্ধ্যায় মন্দিরে বেজে ওঠে ঘণ্টা ও শঙ্খ ধ্বনি। কালের কত বিবর্তন হয়েছে। প্রায় তিন শ’ বছর ধরে বগুড়ায় পাশাপাশি মাজার ও মন্দিরে দুই ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার অনুষ্ঠান পালন করছে। মাজারে জিয়ারত, জিকির আসকর হয়। মন্দিরেও পূজারীরা পূজা করেন ঘণ্টা বাজিয়ে। দুই ধর্মের মানুষ তাদের দুই প্রতিষ্ঠানে যান। কেউ কোন দিন সামান্য কোন মন্তব্য করেননি। যে যার ধর্ম পালন করছে। বগুড়ার মানুষ বংশ পরম্পরায় দেখে আসছে একে অপরের প্রতি হৃদয়ের সহমর্মিতা। সুফি সাধক ফতেহ আলীর (র) জন্মস্থান ভারতের আশকারায়। তার বাবা মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন সাধক। ১০৯০ বঙ্গাব্দে শাহ সুফি ফতেহ আলীর জন্ম। শৈশবে বিদ্যা শিক্ষা অর্জনের জন্য তাকে পাঠানো হয় ছামন্দর নামক স্থানে। সেখানে মজনু শাহ নামে কামেল তত্ত্বজ্ঞের সান্নিধ্যে নয় বছরের সাধনায় উচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। মজনু শাহ’র মৃত্যুর পর তিনি আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। চীনে ১৮ বছর অবস্থানের পর আজমীর শরিফে যান। সেখানে ২১ বছর অবস্থানের পর ১১৬৫ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বগুড়ায় করতোয়া নদীর ঘাটে আস্তানা গড়ে তুলে ইসলাম ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ফার্সী, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় তার দখল ছিল। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুফি সাধক ফতেহ আলীর (র) মৃত্যুর পর সেখানেই তাকে কবর দেয়া হয়। তার কবরকে ঘিরে নামকরণ হয় ফতেহ আলী (র) মাজার। তার জন্মস্থান আশকারা হওয়ায় নামের আশকারী যুক্ত হয়। প্রায় ৫৮ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় মাজারে খাদেমের দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ হায়দার আলী খাতিব। বললেন, বগুড়ায় পাশপাশি মাজার ও মন্দিরের দুই বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে ধর্ম পালন ইতিহাস ধরে রেখেছে। সন্ধ্যায় মন্দিরে ঘণ্টা ও শঙ্খ ধ্বনিতে কোন অসুবিধা হয় না। যে যার মতো ধর্ম পালন করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর অনেকেই মাজারে সালাম দিয়ে মন্দিরে যান। কোনদিন মন্দিরের পুরোহিত ও পূজারীদের সঙ্গে মাজারের লোকজনের সামান্য বাগবিতন্ডা ও কটু কথা হয়নি। ইসলামিক কালচারাল এ্যান্ড ফিচার সার্ভিসের এক প্রকাশনায় আব্দুর রহিম বগ্রা লিখেছেন, মাজার ও মন্দির সংলগ্ন এলাকার নাম আগে ছিল কুন্ডুপাড়া। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস ছিল বেশি। আনন্দময়ী কালীমন্দিরের বংশ পরম্পরায় পৌরহিত করছেন জয়রাম পান্ডের পরিবার। জয়রাম জানালেন, তিনি পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছেন, মাজার ও মন্দির প্রায় একই সময়ের। প্রতি বছর মন্দিরে ধুমধামের সঙ্গে কালী পূজা হয়। শাহ সুফি ফতেহ আলী (র) আশকারীর মৃত্যু দিবস ২২ বৈশাখে মাজারে হাজারো ভক্তের জিকির আসকরে খাবার বিতরণ করা হয়। এই অনুষ্ঠানে অনেক হিন্দু ভক্ত আসেন। তিনি কখনও শোনেননি উপাসনা নিয়ে মাজারের ভক্ত ও পূজার লোকজনের সঙ্গে সামান্য কথা হয়েছে। তারা মনে করেন দুই ধর্মের দুই পুণ্যস্থান। মিলেমিশে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলেছে তারা। বগুড়ার মানুষ প্রতিদিন ফতেহ আলী বাজারে তরিতরকারি মাছ মাংস কেনাকাটায় দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরু রাস্তা দিয়েই যায়। বাজারে বড় মনিহারি দোকানপাট আছে। যেখানে প্রয়োজনীয় সকল পণ্য কেনা যায়। নারী-পুরুষ সকলেই যায় এই বাজারে। তারা দেখে কিভাবে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলেছে দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
×