ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ০০:২০, ২৪ জুলাই ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর তাকে একটু দূরে নিয়ে বকাঝকা করছে ফোরম্যান সিমিওনোভ দেখলাম দূর থেকে। আমার একটু খারাপই লাগতে লাগলো। কিন্তু ঘটনা সত্যিই সিরিয়াস হতে পারতো, তাই সেফটির ব্যাপারে ইভানকে সতর্ক করছে ফোরম্যান বুঝতে পারলাম- এটা তার দায়িত্ব। কিছু পরে ইভান আমার কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করলে আমি ব্যাপারটা সহজ করার জন্য বললাম, ‘সব ঠিক আছে ইভান, কিছু তো ঘটেনি।’ ‘তা ঠিক, তবে...ভুলটা আমারই কমরেড, তুমি কিছু মনে ক’রো না।’ ‘কিছু মনে করিনি, এখন বলেন কী বই পড়ছেন আপনি আজকে? আমারও বই পড়ার অভ্যাস আছে।’ ‘একটা গল্পের বই পড়ছি।’ চোখেমুখে অপরাধি ভাব ফুটে উঠলো ইভানের। ‘কী গল্প?’ ‘‘তারাস বুলবা।’ গোগলের লেখা।’ ‘পড়েছি বইটা।’ আমি বললাম। ‘শেষ দৃশ্যটা মনে আছে। পোলিশদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে বুলবার বাহিনী। তার ছেলেকে ফাঁসি দিয়েছে পোলিশরা। বুলবা তখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। একসময় তিনিও বন্দি হলেন। গাছের সঙ্গে বেঁধে তার পায়ের নিচে আগুণ লাগিয়ে দিল পোলিশ সৈন্যরা। আগুণে পুড়তে পুড়তেও নিজের সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বুলবা...।’ আমাদের কথার মাঝখানে জাখার এলো। কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে শুনে বললো, ‘ও বুলবা! সে তো আমাদের লেজেন্ডারি হিরো। আজকে জ্যান্ত দেখতে পাবে তাকে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বুলবা! সে তো বহুদিন আগে মরে ভূত হয়ে গেছে!!’ ইভান ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো। ‘আজকে প্রজেক্টের ম্যানেজার আসবে। তাকে দেখতে ছবির বুলবার মতোই। তাই...’ বাকিটা জাখার শেষ করলো, ‘তাই ম্যানেজারকে আমরা আড়ালে ডাকি তারাস বুলবা। বুলবার মতোই ইয়া একজোড়া গোঁফ তার। কাজকর্মও বুলবার মতোই। বুলবার এক ছেলে পোলিশ মেয়েকে ভালোবেসেছিল মনে আছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, একটু একটু মনে পড়ছে।’ ‘নিজের দল ছেড়ে পোলিশদের দলে চলে যায় ছেলেটা।’ জাখার বললো, ‘নিজের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে। বুলবা তাকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিয়েছিল, নিজের হাতে গুলি ক’রে মেরেছিল। এইরকম কঠিন ছিল লোকটা। তো আমাদের ম্যানেজারও প্রজেক্টের ব্যাপারে ভীষণ কঠিন, বহুৎ কড়া!’ কড়া লোকটাকে কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম আমরা। তবে তাকে মোটেও কড়া মনে হলো না আমার। খুব হাসিখুশি আর দিলদরিয়া কথাবার্তা তার। অবশ্য গোঁফ দু’টো দেখে সত্যি ভয় লাগে। গালের দু’পাশ বেয়ে এঁকেবেঁকে নেমে গেছে ইংরেজি এস্ অক্ষরের মতো। দু’পাশে একদম সিমেট্রিক, আর ঘনও সেরকম! অনর্গল কথা বলেন কমরেড দাভিদোভ। একটা টুলবক্স মিটিং ডাকলেন তিনিÑ সংক্ষিপ্ত, তাৎক্ষণিক মিটিং। যে যার যন্ত্রপাতির বাক্স টেনে নিয়ে তার উপরেই বসে পড়লো। আমাদের যাদের বাক্স নাই, তারা বসলাম ঘাসের উপর। একটা বাক্সের উপর বসে প্রজেক্টের অগ্রগতি আর সামনের দিনের টার্গেট নিয়ে কথা বলতে লাগলেন ম্যানেজার। লক্ষ্য, লক্ষ্যপূরণ, আয়-ব্যায়, উন্নতি...এইসব গৎবাঁধা কথা। ধৈর্য ধরে শুনলো শ্রমিকরা। তাদের বলার পালা যখন এলো মিস্ত্রি, ফোরম্যান, ওভারশিয়াররা সিমেন্ট, বালু, যন্ত্রপাতির চাহিদার কথা জানালো। ওগুলো ঠিকমতো এবং সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না অভিযোগ করলো। ম্যানেজার আশ্বস্ত করলেন সবাইকে, তিনি কারখানায় কথা বলবেন যাতে জিনিসগুলো ঠিকমতো সাইটে পৌঁছায়। এরপর তিনি বটলগ্রীন জ্যাকেট পরা ছাত্রদের দিকে তাকালেন হাসিমুখে, জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কেমন লাগছে এখানে কাজ করতে? আমরা অনেকেই একসঙ্গে বললাম ভালো কমরেড ম্যানেজার।’ একটা লম্বা চওড়া আফ্রিকান ছেলে উঠে দাঁড়ালো। ওর নাম জোসেফ। সবাই ডাকে বিগ জো। উঠেই সে অভিযোগ-অনুযোগ শুরু করলো, ‘এখানে লাঞ্চে যে রেস্টুরেন্টে আমাদের নেওয়া হয়, সেখানে খাবার ভালো না, পরিমাণও যথেষ্ট না...’ একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিলো, নীরবতাও নেমে এসেছিলো হঠাৎ। অন্য দু’একজন আফ্রিকান ছেলে জোসেফকে থামাতে চাচ্ছিলো। আজিমের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল জো। আজিম ওর জ্যাকেট ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়ালো। বেশ গুছিয়ে বললো, ‘কমরেড ম্যানেজার! প্রথম কথা হলোÑ এখানে কাজ করতে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। যাদের সঙ্গে কাজ করছি, তারা খুবই সদয় আমাদের প্রতি। অতিথির মতো তারা আমাদের দেখাশোনা করছেন এবং সহায়তা করছেন সবসময়। সেজন্য আমি তাদের ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই...’ এটুকু বলতেই ডানদিক থেকে অনেকগুলো মেয়েকন্ঠ শোনা গেল। তারা বেশিরভাগই আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। শুনলাম তারা চেঁচিয়ে বলছেÑ ‘শাবাশ রে বেটা! শাবাশ তোকে!’ এত মেয়ে প্রজেক্টে কাজ করছে আমি জানতামই না। দু’একজনকে দেখেছি আশেপাশে, কিন্তু এখন দেখছি সংখ্যায় তারা অর্ধেকেরও বেশি। এদিকে প্রশংসা পেয়ে আজিম চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ভুলভাল রুশ ভাষায় আরও একটু বক্তৃতা করলো সে, ‘দেখেন, আমরা এসেছি নিজে থেকে, সোভিয়েত মানুষদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখবো বলে। এটা আমাদের জন্য একটা সুযোগ তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার। আমরা আপনাদের বন্ধু হতে চাই...’ আর কিছু বলার আগেই মেয়েদের এবং ছেলেদের উচ্ছ্বসিত আবেগের চীৎকার আর হাততালিতে আজিমের পরের কথাগুলো ভেসে গেল। বসে পড়লো আজিম। হৈচৈ থেমে গেলে শেভচেঙ্কো সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিটিং শেষ করে দিলেন। সেদিন লাঞ্চে আমাদের অন্য একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। ম্যানেজার আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। আমি শুনলাম তিনি জোসেফের দিকে দেখিয়ে তার সহকারীকে বলছেন, ‘এরা লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান যুবক ছেলে, পরিশ্রমও করে প্রচুর। এদের ভালো খাওয়ার দিকটা আমাদের আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল।’ রেস্টুরেন্টে ঢুকে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে তিনি বললেন, ‘এরা আবাসন প্রজেক্টে কাজ করছে, যা খেতে চায় দেবেন, বিল আবাসন প্রজেক্ট থেকে পে করা হবে।’ বিগ জোর পুরো নাম নিজিবালো জোসেফ, সেনেগালের ছেলে। একটু সাদাসিধে বোকাটে টাইপ, পেটুকও খুব। লম্বায় সাত ফুটের উপরে, চওড়াও সেইরকম। স্প্রিংয়ের খাটে ওর দৈর্ঘ্য আঁটে না, কম্বলের নিচ দিয়ে পা বের হয়ে থাকে। জোসেফের আফ্রিকান বন্ধুরা ফান করে ওকে নিয়ে, বলেÑ ‘ইসিনকে বলিস তোর জন্য স্পেশাল একটা খাট বানিয়ে দেবে।’ সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকে ওরা, খুনসুটি করে। এরকম বন্ধুদের মধ্যে লুই একজন। মাদাগাস্কার থেকে এসেছে লুই। ভালো ফ্রেঞ্চ বলতে পারে। জোসেফের ভালো ভালো খাবারের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছেÑ ট্রে হাতে ওর পাশে বসতে বসতে লুই বললো, ‘গুড অ্যাপেটাইট জো!’ প্লেট ভর্তি খাবার সামনে নিয়ে জোসেফ বোকা বোকা হাসি দিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্কুলের মাঠে অ্যাসেম্বলি হয়। এখানেই জানিয়ে দেওয়া হয় পরদিন কার কোথায় কাজ, কোন্ দলে...এইসব। সেদিনও অ্যাসেম্বলি হচ্ছে, ইসিন ব্রিফিং করছে, আমরা অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছি। চারদিকে অন্ধকার। হঠাৎ জোসেফের মুখে একটা মশা ঢুকে গেল। সে থুক থুক করে মশাটাকে বের করতে চেষ্টা করছে। এমন সময় লুই খুব সুন্দর করে উইশ করলোÑ ‘গুড অ্যাপেটাইট জো! গুড প্রোটিন! মজা করে খা!’ সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। ইসিন জানালো পরদিন আমাকে আর শহরে যেতে হবে না, এখন থেকে আমার কাজ খামারে, কৃষকদের সঙ্গে। সপ্তাহে সাতদিনই আমরা কাজ করি। সাতদিনই এক রুটিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে বাসে চেপে শহরে যাওয়া, নাস্তা করে কাজে লাগা, দুপুরে লাঞ্চের বিরতি, তারপর বিকেল পর্যন্ত আবার কাজ করে ভিওস্কি গ্রামে ফিরে আসা। সন্ধ্যায় এদিক-ওদিক একটু হাঁটাহাঁটি, তারপর ঘুম। ব্যতিক্রম শুধু রোববার। সেদিন সন্ধ্যা থেকে সাজ সাজ চলতে থাকে। গোসল করে চুল-টুল আঁচড়ে ফিটফাট হয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ে সবাই। আপেল বাগান ছেড়ে কবরস্থানের পাশ দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে গেলে গ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন, কালচারাল সেন্টার। সেখানে গোটা কয়েক স্টল আর নাচের চত্বর। চত্বরটা খোলা আকাশের নিচে। প্রতিদিন কেউ না কেউ নাচের আসরে যায়, আর চুপিসারে গভীর রাতে ফিরে আসে দলনেতার চোখ এড়িয়েÑ এটা আমার জানা ছিল, কিন্তু কে বা কারা যায়, তা আমি জানতাম না। জানলাম একদিন গভীর রাতে হৈচৈ আর চেঁচামেচির শব্দ শুনে। আমার পাশের বেডে ঘুমায় অস্কার। তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে পেটুক জোসেফ। ওর বেড বরাবর দেয়াল জুড়ে বড় একটা জানালা। অস্কার সেদিন অনেক রাতে ফিরছিল নাচের আসর থেকে। সেখানে ও একজন বান্ধবী পেয়ে গেছে। নেচেগেয়ে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যায় তার। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হনহনিয়ে আসছিল অস্কার। এমন সময় দেখে দূর থেকে কে যেন আসছে, ছায়ামূর্তির মতো। একটু ভয় পায় অস্কার। আবছা আলোয় দেখে ছায়াটা অনেক লম্বা, আর আসছে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে। একটা গাছের আড়ালে সরে যেতে চেষ্টা করে অস্কার। তার আগেই ওটা হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে অস্কারের একদম গায়ের উপর। এতক্ষণে ও বুঝতে পারে ছায়াটায়া কিছু না, একটা মানুষ। এসেছে সাইকেলে চড়ে। তাই এতো দ্রুত আসছিল আর এতো লম্বা দেখাচ্ছিলো তাকে। সাইকেল আরোহী বেশ বয়স্ক, বুড়ো দাদু। লোকটা ভোদকা-টোদকা কিছু খেয়েছে। অথবা ঘরে তৈরি সামাগন। সাইকেলটা সে ঠিকমতো চালাতে পারছে না। কে জানে কবরস্তানের পাশে অস্কারকে দেখে সে-ও ভয় পেয়েছে কিনা! রাশানরা ভূত-টূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু রেগে গেলে প্রায়ই গালি দেয়Ñ ‘শয়তানে নিক তোকে।’ রাস্তা থেকে গড়গড়িয়ে নেমে ব্যালেন্স হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল সাইকেলটা। ছিটকে পড়ে গেল বুড়ো। উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে জড়ানো গলায় অস্কারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কে রে বাপু! শয়তান না তো!’ অস্কার বললো, ‘দাদু, আমি ছাত্রদের একজন। আমার নাম অস্কার।’ ‘ভালো ভালো। তা এত রাতে কোন্ জাহান্নামে যাচ্ছিস?’ ‘স্কুলঘরে যাচ্ছি, আমাদের ক্যাম্পে।’ ‘এতক্ষণ বুঝি ঘুরঘুর করছিলি বান্ধবীর সঙ্গে?’ অস্কার জবাব না দিয়ে হাসলো। বুড়ো সাইকেলটা মাটি থেকে তুলতে তুলতে বললো, ‘শোন্ তোকে একটা কথা বলি। ভালো বান্ধবী পেলে ছাড়বি না, ধরে রাখবি। ভালো মেয়েরা হচ্ছে মাটির মতো, তুই ওদের বীজ দিলে ওরা তোকে সোনালী ফসল দেবে, বুঝলি? মনে থাকবে?’ অস্কার ঘাড় হেলালো। সাইকেলে উঠতে গিয়ে থামলো বুড়ো, ‘ও হ্যাঁ...কোথায় যাবি যেন বলছিলি?’ ‘স্কুলঘরে, ক্যাম্পে।’ ‘সে তো অনেকটা পথ, যাবি কীভাবে?’ ‘হেঁটেই যাচ্ছিলাম, সেভাবেই যাবো।’ ‘এক কাজ র্ক... আমার সাইকেলটা নিয়ে যা। তাড়াতাড়ি হবে।’ ‘না দাদু, তুমি যাও, আমি হেঁটেই চলে যেতে পারবো।’ ‘না না কথা শোন্, নিয়ে যা। আমি পড়ে যাচ্ছি বারবার, দেখছিস না? আজকে একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে রে, বুঝলি তো...? এই নে...’ প্রায় জোর করেই সাইকেলটা গছিয়ে দিল বুড়ো। অস্কার জিজ্ঞেস করলো, ‘ফিরিয়ে দেবো কীভাবে?’ যেদিকে যাচ্ছিলো, সেদিকটায় রওনা দিয়ে বুড়ো বললো, ‘ফিরিয়ে দিতে হবে না। স্কুলের অফিসঘরের সামনে রেখে দিস। আমি এসে নিয়ে যাবো একসময়।’ (চলবে)
×