ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাহেদকান্ডে সব সংস্থা মাঠে, হটলাইনে অভিযোগের পাহাড়

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২০ জুলাই ২০২০

সাহেদকান্ডে সব সংস্থা মাঠে, হটলাইনে অভিযোগের পাহাড়

আজাদ সুলায়মান ॥ দেশের প্রধান সংস্থাগুলো একযোগে মাঠে নেমেছে সাহেদের অপরাধ জগতের তথ্য সংগ্রহে। র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ আরও দুটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা সাহেদের আমলনামা সংগ্রহ করছে। সাহেদ ইস্যুতে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি বা হার্ডলাইনে অবস্থান নিয়েছে। এই মহাপ্রতারককে শনিবার রাতে ডিবি পুলিশ উত্তরায় একটি অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র গাড়ি ও মদ উদ্ধার করেছে। সাহেদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রদর্শনে গতকাল তার এ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও বাতিল করা হয়েছে। একইভাবে সারাদেশ থেকে ভুক্তভোগীরা এন্তার অভিযোগ নিয়ে আসছে। র‌্যাব কার্যালয়ে হটলাইনে অভিযোগের পাহাড় জমছে। র‌্যাব জানিয়েছে, সব অভিযোগের মামলা হবে না। তারপরও অন্তত শতাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে যেগুলো মামলা করার মতো। সেজন্য অন্তত অর্ধশত মামলা হতে যাচ্ছে। বর্তমানে ডিবির হেফাজতে থাকা সাহেদ ইতোমধ্যে রিজেন্ট হাসপাতালের করোনার নকল সনদ বাণিজ্য ও অন্যান্য প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে। এখন তার আশ্রয় প্রশয়দাতাদের চিহ্নিত করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবি জানিয়েছে, ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি মাদক-অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে প্রতারক সাহেদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণা, দখল বাণিজ্য, বদলি ও প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার আদায় করা সম্পর্কে গুরত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। শুধু দেশে নয়, প্রবাসীরাও সাহেদের প্রতারণায় শিকার হয়েছেন। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাহেদকে নিয়ে শনিবার মধ্য রাতে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় অস্ত্র, মদ, ফেনসিডিল ও পিস্তল জব্দ করা হয়েছে। সাহেদ বর্তমানে র‌্যাবের করা মামলায় আদালতের নির্দেশে ডিবির কাছে ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। তার দুই সহযোগীও রিমান্ডে রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। এ দুটি মামলায় এরইমধ্যে সাহেদকে শ্যোন এ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। সোমবার মামলার নথিপত্র আদালতে পাঠানো হবে। শনিবার মধ্য রাতে ডিবি সদস্যরা সাহেদকে নিয়ে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপদ রোডের ৬২ নম্বর বাসার সামনে অভিযান চালায়। সেখানে সাহেদের নিজস্ব সাদা প্রাইভেটকার ছিল। সেই প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে ডিবির সদস্যরা ৫ বোতল বিদেশী মদ, ১০ বোতল ফেনসিডিল ও একটি পিস্তল জব্দ করে। এদিকে র‌্যাব সদর দফতরের হটলাইনে সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ আসছে। প্রতি ঘণ্টায় এক ডজনের বেশি অভিযোগ জমা হচ্ছে। রাজধানী ও বাইরে থেকে মোবাইল ফোন ও খুদে বার্তায় মানুষ জানাচ্ছে তাদের অভিযোগ। এ ছাড়াও সরাসরি হাজির হতে চাইছে অনেকেই। দুদিন আগে চালু করা ওই হটলাইনে প্রায় দেড় শত অভিযাগ পাওয়া গেছে। ফোন কল ও ইমেলের মাধ্যমে আসছে এসব। সাহেদের বিরুদ্ধে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া, রিজেন্টের কর্মচারীদের বেতন না দেয়া, সরকারী চাকরি পাইয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ মিলেছে বেশি। এসব বিষয়ে রবিবার র‌্যাবের অফিসে লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, সাহেদকে গ্রেফতারের পর আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। সেখানে সাহেদ করিম তার সব অপরাধ অপরাধ স্বীকার করেন। পরে সাহেদ করিমের ড্রাইভার ও এমডির ড্রাইভারকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা গত ১৭ জুলাই র‌্যাবের একটি সেবালাইন (হেল্পলাইন- ০১৭৭৭৭২০২১১) চালু করি। সেবালাইনের উদ্দেশ্য ছিল যারা রিজেন্ট হাসপাতাল বা সাহেদ করিমের হাতে প্রতারিত হয়েছেন, তাদের আইনী পরামর্শ ও আইনী সহায়তা দেয়া। এতে আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। এছাড়া একটি অফিসিয়াল ইমেলে বিস্তারিত তথ্যের জন্য আহ্বান জানাই। রবিবার পর্যন্ত ফোন ও ইমেলে প্রায় দেড় শ’ অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলোর মধ্যে চাকরি পাইয়ে দেয়া ও বিভিন্ন দফতরে বদলির সুপারিশের আশ্বাস দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাত, বিভিন্ন জায়গায় বালু ভরাট, রড-সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের কথা বলে টাকা আত্মসাত, রিজেন্ট হাসপাতালে সেবার নামে অতিরিক্ত ফি আদায়, রিক্সা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স দেয়ার তথ্য মিলেছে। এছাড়া রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজ ও সাহেদের বিরুদ্ধে সরকারী ও বেসরকারী কয়েকটি ব্যাংক থেকে ফোন দিয়ে ঋণ নেয়া সংক্রান্ত অভিযোগ মিলেছে। এমনকি সাহেদ ও মাসুদের বিষয়ে বিদেশ থেকেও আমাদের কাছে ফোনকল আসে। বিদেশের অনেকেই এই দুজনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন বলে ফোন করেছেন। যারা বিদেশ থেকে ফোন করেছেন তাদের অভিযোগ অর্থ সংক্রান্ত প্রতারণার। যেসব ফোনকল ও ইমেল পেয়েছি সবই মূল অংশ ছিল আর্থিক লেনদেন। আমাদের কাছে আসা অভিযোগ অনুযায়ী, সাহেদ আনুমানিক ১০ কোটি টাকার মতো প্রতারণা করেছে। আগামী দু-তিন দিন এই হটলাইনে অভিযোগ নেয়া হবে। এ মামলার তদন্তভার নেয়ার জন্য র‌্যাব পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরা¿ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে র‌্যাব তদন্তভার নেবে। প্রতারণা ধরন সম্পর্কে আশিক বিল্লাহ জানান, সাহেদ সরকারী চাকরি দেয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। এছাড়া সরকারী চাকরিতে বদলি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ সাহেদ করিম করতেন। বদলির জন্য অনেকেই তাকে টাকা দিয়েছিল। সাহেদের পৃষ্ঠপোষকদের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা দেখবেন। অভিযোগদাতাদের মধ্যে সাহেদের প্রতিষ্ঠানের কেউ আছেন কিনা? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, র‌্যাবের কাছে সাহেদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা ফোন দিয়েছেন। সাহেদ তাদের বেতন দিতেন না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলার কারণে সাহেদ সমাজের গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গিয়েছিলেন কিনা। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, যে কেউ যে কারও সঙ্গে ছবি তুলতে পারে। যাদের সঙ্গে সাহেদের ছবি তোলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাদের সঙ্গে সবাই ছবি তুলতে চায়। ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই এসব প্রতারণা করা যাবে, এগুলো বলা যাবে না। সাহেদ করিম একজন প্রতারক আইডল। প্রতারকের যে ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত সবই তার মধ্যে আছে। সাধারণ মানুষ তার গুরুত্বপূর্ণ আবহ দেখে তাকে বিশ্বাস করতেন। সাহেদের বিরুদ্ধে হত্যা-নির্যাতনের মতো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আছে কি-না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, হত্যার মতো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ পাইনি। যেসব পেয়েছি সবই প্রতারণার। তবে হাসপাতালে একটি টর্চার সেল ছিল, সেখান থেকে আমরা কিছু জিনিস জব্দ করেছি। সাহেদের টর্চারের ধরন কেমন ছিল? সাংবাদিকরা জানতে চাইলে র‌্যাবের এ পরিচালক বলেন, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি উনি খুব মারপিট করতেন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেন। এদিকে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদের এ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে সরকার। দৈনিক নতুন কাগজ নামে একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে এ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নেন মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। তার কার্ডের নম্বর-৬৮৪৫। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তার কার্ডটি ইস্যু করে তথ্য অধিদফতর (পিআইডি)। এক বছর মেয়াদী কার্ডের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। রবিবার প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার সাংবাদিককে বলেন, এ বিষয়টি আমাদের নীতিমালার মধ্যেই বলা আছে। যদি কেউ প্রতারণামূলক কাজের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাহলে এ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। তাই আমরা তার কার্ডটি বাতিল করেছি। উল্লেখ্য, গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রোগীদের সরিয়ে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। এরপর থেকে পালাতক ছিলেন সাহেদ। তবে ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরদিন ১৬ জুলাই সাহেদ এবং রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। আর সাহেদের প্রধান সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে সাতদিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। মামলার তদন্তভার এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে।
×