ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অদৃশ্য প্রভাবে ফাইল আটকে থাকে

লঞ্চ দুর্ঘটনার পর তদন্ত হলেও শাস্তি হয় না

প্রকাশিত: ২২:২৭, ৩০ জুন ২০২০

লঞ্চ দুর্ঘটনার পর তদন্ত হলেও শাস্তি হয় না

রশিদ মামুন ॥ দুর্ঘটনার পরই ব্যাপক হৈ চৈ আর লোক দেখানো তদন্তের পর শাস্তি না হওয়াতে নৌদুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামানো যাচ্ছে না। সরকারী পরিসংখ্যান বলছে গত ৪৫ বছরে ছোট বড় মিলিয়ে ৬৫৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সবমিলিয়ে চার হাজার ৭৪১ জনের। সবচেয়ে নিরাপদ যাত্রার নৌপথে বছরে প্রায় ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটছে। একটু সতর্ক হলেই নৌদুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। নৌদুর্ঘটনার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদফতর এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এসব তদন্ত কমিটি বিভিন্ন সময়ে দেয়া প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করে সেগুলো বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব থাকে মন্ত্রণালয়ের হাতে। কিন্তু মন্ত্রণালয় এক অদৃশ্য প্রভাবে সব ফাইল বন্ধ করে রাখে। এমভি মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। শ্যামবাজারের কাছে নদীতে চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যায়। সোমবার দুর্ঘটনার পর নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মনজুরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দুটি লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট যাচাই বাছাই করে দেখেছি তাদের সব কাগজপত্র ঠিক ছিল। একটি নৌদুর্ঘটনা ঘটার পর জাহাজ মালিক থেকে শুরু করে নৌযানটির পরিচালকদের দায় খোঁজা হয়। একই সঙ্গে নৌযানের ফিটনেসে কোন ত্রুটি থাকলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দায়ের অনুসন্ধান হয়। কিন্তু কোন একটি দুর্ঘটনার পর যাদের তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় তারা সকলে এইখাত সংশ্লিষ্ট। দেশের বাইরে নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করা হয়। কিন্তু এখানে তদন্তকারী অপরাধীদের ঘনিষ্ঠজন। ফলে তদন্তেই গলদ থাকে। এরপর যতটুকুই দায় নির্ধারণ হয় তারও খুব বেশি বড় শাস্তির কোন নজির নেই। নৌদুর্ঘটনার জন্য পৃথক আদালত রয়েছে। সেখানেও মামলার পাহাড় জমে আছে। বছরের পর বছর ধরে চলা মামলার সুরাহা হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ফলে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নৌযান মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন সংস্থার সদস্যও এরা। সারাদেশের লঞ্চ মালিকদের নিয়ে গঠিত এই সমিতি পরিচালিত হয় সরকার সমর্থকদের নিয়ে। ফলে কোন সময়ই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না। ফলে তদন্তর সুপারিশ বাস্তবায়নে সবক্ষেত্রেই বাধার মুখে পড়তে হয়। অন্যদিকে নৌযান চলাচলের সনদ দেয়ার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত কোন ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে নানাভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ১৯৮৬ সালে ১১ দুর্ঘটনায় ৪২৬, ১৯৯০ সালে ১৩ দুর্ঘটনায় ১৬৮, ১৯৯৩ সালে ২৪ দুর্ঘটনায় ১৮৩, ১৯৯৬ সালে ২০ দুর্ঘটনায় ১৪৭, ২০০০ সালে ৯ দুর্ঘটনায় ৩৫৩, ২০০২ সালে ১৭ দুর্ঘটনায় ২৯৭, ২০০৩ সালে ৩১ দুর্ঘটনায় ৪৬৪, ২০০৫ সালে ২৮ দুর্ঘটনায় ২৪৮, ২০০৯ সালে ৩৪ দুর্ঘটনায় ২৫১ ও ২০১২ সালে ১৫ দুর্ঘটনায় ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে বিভিন্ন নৌদুর্ঘটনায় ৬০, ১৯৯৬ সালে ৪৭, ১৯৯৮ সালে ৫৮, ২০০০ সালে ৫০ ও ২০১৪ সালে ৬৭ জন নিখোঁজ হন। ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে সোমবার এমভি মর্নিং বার্ড নিমজ্জিত হওয়ার পর ৩০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। লঞ্চটি ৫০ থেকে ৬০ যাত্রী নিয়ে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসছিল। ঘাটে নোঙর করার ঠিক আগে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। অন্য একটি লঞ্চের ধাক্কায় মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে যায়। কয়েকটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখে গেছে ২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনলে এমভি সালাউদ্দিন-২-এর ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে দায়িত্বে অবহেলার জন্য তৎকালীন সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী, জরিপকারকসহ চার কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়। নকশামাফিক লঞ্চ নির্মাণ না করায় মালিককে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য মাস্টারকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ঘটনায় মালিককে জরিমানা এবং মাস্টারকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি দেয়ার বাইরেই রাখা হয়। এরপর ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এ দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনা এমভি নাসরিন বিপর্যয়ে ৩৬ শিশুসহ আট শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। গঠিত হয়েছিল দুটি তদন্ত কমিটি। কিন্তু এক্ষেত্রেই দায়ীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এরপর ২০১৪ সালে পিনাক দুর্ঘটনার পর মালিককে ধরে আনা হলেও কয়েকদিনের মধ্যে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। জানতে চাইলে নৌ সড়ক এবং রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, দুর্ঘটনার পর দায়ীদের কোনদিনই কোন শাস্তি হয় না। নৌপরিবহন অধিদফতর এবং বিআইডব্লিওটিএ’র যাদের দায়ী তাদের কারও কোনদিনই চাকরি যায়নি বা পদাবনতি করা হয়নি। শুধু কিছু সময়ের জন্য কাউকে কাউকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে মালিকদেরও শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। ফলে কেউ কোনদিন সতর্ক হয়নি।
×