ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

শিক্ষাই সবকিছুতে এগিয়ে

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৯ জুন ২০২০

শিক্ষাই সবকিছুতে এগিয়ে

শিক্ষা মন্ত্রণা-লয়ের এক বিবৃতিতে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য ৪৬ কোটি টাকার বেশি বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছেন। এটা আমাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কি না জানি না, দাবির প্রেক্ষিতে তো নয়ই। কারণ আমরা কখনও প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন দাবি জানাই না, অনুরোধও করি না, মাঝে মাঝে স্মরণ করিয়ে দেই মাত্র। তাতেই কাজ হয়। কারণ আমাদের শিক্ষকদের অভাব অভিযোগ কিংবা দাবি-দাওয়া মনে হয় তার নখদর্পণে। করোনার শুরুতেই বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত শুধু নয়, সে সবের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ছাড় দেয়া হয়েছে। বর্তমান বাজেটে শিক্ষার জন্য আগের চেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেটাও শিক্ষার প্রতি গভীর সচেতনতা ও মমত্ববোধের লক্ষন। আশা করছি বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে, যাতে এমপিওভুক্ত বিপুল সংখ্যক বেসরকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অন্তত বেঁচে থাকতে পারে। তারা সবচেয়ে অবঞ্চিত-কারণ তারা ‘না পারে চাইতে, না পারে খাইতে’। ছাত্রছাত্রীদের ফিসের ওপর তারা সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। নির্ভরশীলতা আছে টিউশনির ওপরেও। দুটোর দুয়ারই প্রায় বন্ধ এবং কার্যত দুর্গতির মাত্রা সেখানে বেড়েই যাচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে আয়ের দুটু উৎসই সঙ্কুুচিত হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এটা যেমন বেসরকারী স্কুল-মাদ্রাসার জন্য এসেছে, তেমনি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যতই গাল-গল্প প্রচলিত থাক না কেন, তাদের পড়ুয়াদের গড়ে ৬০ শতাংশ দরিদ্র ও মেধাবী পরিবারের সদস্য। করোনার আঘাতে এসব পরিবার আরও বিধ্বস্ত। তাদের বেকারত্বের হার ও সংখ্যা সর্বোচ্চ। শিক্ষার্থীদের একাংশ বিদেশী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বস্তুতপক্ষে, বিদেশে কর্মসংস্থান ব্যাপক হারে বৃদ্ধি উচ্চ শিক্ষাকেও উৎসাহিত করেছে। এখানে যে টানাপোড়েন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাবে বেসরকারী শিক্ষাঙ্গনে অর্থ আগমন ও অর্থায়ন আরও কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সুখবর বটে। তবে এই অর্থ যে অনেকের প্রাপ্ত চূড়ান্ত অর্থ তা বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থাৎ দপ করে জ¦লে উঠে প্রদীপে পূর্বাভাস দিচ্ছে যে, প্রদীপের তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই সঙ্কটটা উত্তরণের দায়ভারও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপরই পড়বে। প্রযুক্তি উপযোগী শিক্ষা ও কর্ম উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে নিরুপায় বিদেশ প্রত্যাগতদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে তার বিরূপ প্রভাব সর্বত্র পড়বে। আশঙ্কা করা যাচ্ছে চাপাচাপি যতই করা হোক না কেন বেসরকারী শিক্ষা খাত বাঁচাতে হলে কিংবা চলমান রাখতে হলে সরকারী সাহায্য প্রয়োজন হবে। দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ আসছে। তারা জুলাই থেকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে সামিল হবে, এর কাঠামোগত অসুবিধা দূরীকরণে আরও অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন যে। শিক্ষাঙ্গনের ৯০ শতাংশ এখনই অনলাইনে কার্যক্রম চালাতে সমর্থ। আরও একটু সহযোগিতা দিলে তা শতভাগে পৌঁছে যাবে। বিদ্যুতে উদ্ধৃত্ত লক্ষিত হলেও বিদ্যুত ব্যবস্থাপনার মাঠ পর্যায়ে অব্যবস্থাপনার কারণে সংশ্লিষ্টরা বদনাম কুড়াচ্ছেন। অনলাইন শিক্ষার জন্য বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে ব্রড ব্যান্ডের আরও সাশ্রয়ী প্রাপ্যতা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন শিক্ষার সুবিধার্থে শিক্ষামন্ত্রী কতিপয় ক্ষেত্রে সম্পূরক করারোপের সমালোচনা করেছেন। বিষয়টা সঙ্গত ও যথার্থ। কিছুদিন আগে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এসব কর ব্যবস্থা সংস্কার বা পূর্ববত রাখার অনুরোধ জানালেও এখন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা, আইফোন বা স্মার্টফোন সরবরাহের দাবি জানাই। অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা পৈত্রিক সম্পদ দিয়ে এগুলোর ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু ‘ঘোড়া দেখলে খোঁড়া, আর নাপিত দেখলে নককুনী বাড়ে’ বলে বোধকরি সমস্যাটাকে জটিলতায় আনা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সুতা নিম্ন দরে বিক্রি শুরু হলে বহু ভদ্রলোকও জোলা হতে মনস্তাত্ত্বিক বাধা বোধ করছিলেন না। এবারেও এমন অবস্থা কম বেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যার আইফোন আছে, সেও বিনে পয়সায় আর একটা আইফোন প্রত্যাশী হচ্ছে। যার ফি পরিশোধের ক্ষমতা আছে, সেও পূর্বে যা দিয়ে ফেলেছে তার জন্য আফসোস করছে এবং ভবিষ্যতে না দেয়ার মতলব আঁটছে। এগুলো বাস্তব সমস্যা। এসব কিভাবে সমাধান হবে তার উপায় আগত বাজেটে রাখতে হবে। ইউজিসিকে ধন্যবাদ যে, তারা অনলাইন শিক্ষায় সবাইকে টানতে পেরেছে। শিক্ষামন্ত্রী নির্দ্বিধায় ঘোষণা দিয়েছেন যে, করোনা চলে গেলেও অনলাইন শিক্ষা আরও সুসংহত করা হবে। এটা বিশ্বময় প্রবণতা। বহুদেশে করোনা নামক মহামারীর আগমনের আগেই দূর শিক্ষণ বা অনলাইন শিক্ষা চালু হয়েছে। দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষাদান, পরীক্ষা গ্রহণ, পরিক্ষণ কার্যক্রম অনলাইনের বিভিন্ন পোর্টালের একক কিংবা মিশ্রিত ব্যবহার দিয়ে অনেক বিরূপ সমালোচনার জবাব ইতোমধ্যে দিয়ে ফেলেছে। করোনা রূপ বদলাচ্ছে, চরিত্র বদলাচ্ছে। তাই করোনার চিকিৎসা ও প্রতিষেধক হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রকারের করোনার কারণে আবারও সংক্রমন পরিস্থিতি হতে পারে। তাই শিক্ষার অনলাইন কার্যক্রম আমাদের জীবন সঙ্গী হবে আগামীতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গতিশীলতার আর এক লক্ষণ হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনের শূন্য পদগুলো যথার্থ যোগ্য ব্যক্তি দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং ইউজিসিতে যাদের নিয়োগ দেয়া হবে বলে খবর আছে তারাও যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হবেন। ২০ লাখ শিক্ষার্থীর বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন শিক্ষামন্ত্রী। উচ্চ শিক্ষার সেশনজটের বাস্তব সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। তবে অচিরেই ঋণের ব্যবস্থা না করলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে হুমকিতে পড়বে তা প্রায় ৯৫ ভাগ নিশ্চিত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা, উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
×