ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী হত্যায় জড়িতদের শাস্তি চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ৩০ মে ২০২০

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী হত্যায় জড়িতদের শাস্তি চায় বাংলাদেশ

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরো ঘটনার তদন্তসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার, দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। খবর বাংলানিউজ ও ওয়েবসাইটের। এতে উল্লেখ করা হয়, বৃহস্পতিবার লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিজদাহতে (ত্রিপোলি হতে ১৮০ কিমি দক্ষিণে) কমপক্ষে ২৬ জন বাংলাদেশীকে লিবিয়ান মিলিশিয়ারা গুলি করে হত্যা করেছে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে দূতাবাসের অনুসন্ধানে জানা যায়, লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী অপহরণ করা বাংলাদেশীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালালে আনুমানিক ২৬ জন বাংলাদেশী ঘটনাস্থলে নিহত হন। আক্রান্তদের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হলে তিনি জানান যে, তিনি একজন লিবিয়ানের আশ্রয়ে আত্মগোপনে আছেন। তিনি দূতাবাসকে আরও জানান, ১৫ দিন পূর্বে বেনগাজী থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে মানবপাচারকারীরা এসকল বাংলাদেশীকে ত্রিপোলিতে নিয়ে আসার পথে তিনিসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশী মিজদাহ শহরে কাছে লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনীর একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে জিম্মি হন। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে জিম্মিকারীরা অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্যে মূল অপহরণকারী লিবিয়ান নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে যাতে আনুমানিক ২৬ জন বাংলাদেশী নিহত হয় এবং আরও ১১ জন বাংলাদেশী হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। এ সংবাদ পাওয়ার পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা মিজদাহ হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া মরদেহগুলো মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আহতদের পরবর্তীতে দূতাবাসের সহায়তায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ত্রিপোলিতে অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালে আনা হয়েছে। গুরুতর আহত তিনজনের শরীর হতে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস লিবিয়ার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং আইওএম লিবিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখছে এবং তারা আহত ব্যক্তিদের জন্য সম্ভাব্য সহায়তা প্রদান করছেন। মিশনের কর্মকর্তারা আহতদের কাছ থেকে ঘটনার বিশদ বিবরণসহ নিহতদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের সুচিকিৎসার নিশ্চিতকরণে দূতাবাসকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ইতোমধ্যে দূতাবাস লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরো ঘটনার তদন্তসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার, দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন। মিজদাহ শহরে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এবং এ অঞ্চলটি এখন দুটি শক্তিশালী পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে। কিছুদিন আগে ত্রিপোলিভিত্তিক এবং ইউএন সমর্থিত জিএনএ সরকার এই অঞ্চলটি দখল করে নিলেও জেনারেল হাফতারের নেতৃত্বাধীন পূর্বভিত্তিক সরকারী বাহিনী দুদিন আগেও শহরটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের এ অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। বর্তমানে এমনকি ত্রিপোলি শহরেও বিরোধীপক্ষ মাঝেমাঝে বোমাবর্ষণ করে থাকে। দুটি শক্তিশালী পক্ষ যুদ্ধরত থাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নয়। এ কারণে অধিকাংশ দেশ তাদের দূতাবাস তিউনিসিয়াতে স্থানান্তর করলেও বাংলাদেশসহ মাত্র তিনটি দেশ তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এ প্রতিকূল অবস্থাতেও বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশীদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সব প্রকার মানব পাচারের সম্পূর্ণরূপে বিরোধী এবং মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যার ফলে বাংলাদেশ হতে মানবপাচারের পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। আহত ১১ জনের মধ্যে ৬ জন সম্পূর্ণ সুস্থ ॥ হতভাগ্য ৩৮ বাংলাদেশী তিন মাস আগে লিবিয়া পৌঁছেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আহত ১১ জনের মধ্যে ছয় জন এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং বাকি পাঁচ জনের অবস্থা সঙ্গীন।’ এদের মধ্যে তিন জনের অপারেশন হয়েছে এবং বাকি দুই জনেরও অপারেশন হবে বলে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এরা বেশ অসুবিধার মধ্যে আছেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আহতদের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় বুলেট লেগেছে এবং সেগুলো বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ লিবিয়ায় বাংলাদেশ মিশন ত্রিপোলি মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘লিবিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আমাদের সহায়তা করছে।’ মৃতদেহগুলো মিজদাহ শহরে একটি হাসপাতালের মর্গে আছে এবং আমরা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে অনুরোধ করেছি তাদের একটা ব্যবস্থা করার জন্য বলে জানান মন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের মিশন লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে জানিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি করেছি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার এবং দোষী ব্যক্তিদের তথ্য আমাদের দেয়ার জন্য।’ যে ছয় জন সুস্থ আছেন আমরা আজ তাদের সঙ্গে কথা বলে নিহত বাংলাদেশীদের পরিচয় জানব এবং তারা কোন পাচারকারীর মাধ্যমে গেছেন, সেটিও জানতে পারব বলে জানান মন্ত্রী। পাচারকারীরা এখনও সক্রিয় আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এর আগে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবির পরে ১৬ জন বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশী আমাদের জানিয়েছিল বাংলাদেশের পাচারকারী কারা, কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিল, সেই তথ্য দিয়েছিল। আমরা কিছু গ্রেফতারও করেছিলাম।’ লিবিয়ার এ ঘটনায় যেসব বাংলাদেশী বেঁচে আছেন, তাদের বরাত দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এখানে মূল ঘটনাটা হচ্ছে তারা ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার খরচ করে গিয়েছিল। কিন্তু পাচারকারী দল আরও টাকা চাচ্ছিল এবং অত্যাচার করছিল। তারা টাকা দিতে চাননি। তাদের মধ্যে ঝগড়ার সময়ে একজন আফ্রিকান লোক তাদের প্রধান পাচারকারীকে মেরে ফেলে।’ ওই পাচারকারী মারা যাওয়ার পর তার পরিবার ও অন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ফলে আমাদের ২৬ জন ভাই মারা যান বলে জানান মন্ত্রী। হত্যার ঘটনা তদন্তে নেমেছে লিবিয়া ॥ লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জন অবৈধ অভিবাসীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, লিবিয়ার মিজদা শহরের এক নাগরিক অবৈধ অভিবাসীদের উপকূলীয় শহরে পাচারকালে তাদের হাতে নিহত হন। এতে ওই ব্যক্তির স্বজনেরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন এবং বাংলাদেশের ২৬ জন ও আফ্রিকার চারজনকে হত্যা করেন। এসময় আহত হন আরও ১১ জন। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা মিজদা শহরের নিরাপত্তা বিভাগকে দোষীদের গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। দেশটি বলছে, এই গণহত্যার পেছনে উদ্দেশ্য যা-ই থাক, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অনুমতি কারোরই নেই। নিহত ৮ জনের বাড়ি ভৈরবে ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা ভৈরব থেকে জানান, লিবিয়ায় পাঁচারকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশী অভিবাসীর মধ্য ৮ জনের বাড়ি ভৈরবের বিভিন্ন গ্রামে। লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে জিম্মি অভিবাসী নিহতের খবর পরিবারের সদস্যদের কাছে আসার পর থেকেই প্রতিবাড়িতেই স্বজনহারাদের কান্নার রোল পড়ে। গ্রামে হাট-বাজারে শুধু মানুষের মুখে লিবিয়ার বর্বরতম ঘটনার কথা। লিবিয়ায় ভৈরবে আটজন নিহতের খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ভৈরব থানার পরির্দশক তদন্ত বাহালুল বাহার। নিহতরা হলো- সাকিব (১৮) পিতা বাচ্চু মিয়া, শ্রীনগর, সোহাগ (২২) পিতা আঃ আলী, মৌটুপী, আকাশ(২৫) পিতা মের আলী, রসুলপুর, জানু মিয়া (২৭) পিতা সাত্তার, শম্ভুপুর, মামুন (২৬) পিতা লিয়াকত শম্ভুপুর, মোঃ আলী(২৫) পিতা মুকসেদ শম্ভুপুর । শুক্রবার দুপুরে ভৈরবে সাদেকপুরের রসুলপুরের মেহের আলী মিয়ার বাড়িতে গিয়ে ছোট ছেলে আকাশের মৃত্যুর খবরে স্বজনদের কান্নায় প্রতিবেশীদের চোখের অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে প্রবাসে গিয়ে দালাল চাক্রের হাতে জিম্মি হয়ে আর যাহাতে কোন মায়ের বুক খালি না হয় এমনই দাবি এলাকাবাসীর। এসব দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এলাকাবাসীর। ভৈরবে সাদেকপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের মেহের আলী মিয়ার ৯ সন্তানের মাঝে সবার ছোট আকাশ লিবিয়ার পাড়ি জমায়। সেখানে সে একটি ফার্নিচার কোম্পানিতে চাকরি করছিল। সে সময় পরিচয় হয় ভৈরবের শ্রীনগর গ্রামের সোনামিয়ার ছেলে দালাল তানজিমুলের সঙ্গে। আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে ইতালি পৌঁছে দেবার চুক্তিতে ১৫ দিন আগে বেনগাজী থেকে গাড়িতে ত্রিপোলি রত্তনা হয়। রত্তনার পরপরই দালাল চক্র তাদের পাসপোর্ট নগদ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। তারপর থেকে তাদের কোন খোঁজ পাচ্ছিল না। হঠাৎ খবর আসে যে একটি মাফিয়া চক্রের হাতে তারা জিম্মি ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ সময় তাদের বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে অডিওতে পরিবারকে জানানো হতো। এ অবস্থা একই ইউপির মৌটুপী গ্রামের আঃ আলীর ছেলের সোহাগের একবছর আগে অভাবের সংসারে সচ্ছলতা আনতে লিবিয়ায় যায়। দালাল তানজিলুলের খপ্পরে পরে তার দরিদ্র পিতার কান্নায় যেন একমাত্র সম্বল। ৪ ছেলে ১ মেয়ে মাঝে সোহাগই বড় সংসারের সুখ ফিরিয়ে আনতে দালালদের লোভের স্বীকার হয়ে প্রাণ দিতে হলো তাকে। এলাকাবাসীর দাবি এসব দালালদের আটক করে আইনের আওতায় আনার। ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ শাহিন বলেন, ভৈরবে যদি মানব পাচারচক্র থাকে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।
×