ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্পষ্ট হচ্ছে কোভিড-১৯ এর প্রভাব

ত্রস্ত রাজধানী শহর, রাস্তা ফাঁকা হচ্ছে ঘরে ঢুকছে মানুষ

প্রকাশিত: ১০:৪২, ২৩ মার্চ ২০২০

ত্রস্ত রাজধানী শহর,  রাস্তা ফাঁকা হচ্ছে  ঘরে ঢুকছে মানুষ

মোরসালিন মিজান ॥ দেখতে দেখতে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আগের সেই ভিড় নেই। মার্কেট, শপিংমল খোলা থাকলেও, ক্রেতাশূন্য। গণপরিবহনের সংখ্যা কমেছে। তার চেয়েও কম যাত্রী। প্রাণোচ্ছ¡ল গল্প-আড্ডার চেনা স্থানগুলো এখন নির্জন। হ্যাঁ, এমন ছবি প্রতি ঈদেই দেখা যায়। তবে বর্তমানের ছবিটি তার থেকে আলাদা। এ ছবিতে উৎসব বা উদ্যাপনের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং অজানা শঙ্কা জায়গা করে নিয়েছে। কারণটি বলার অপেক্ষা রাখে না, কোভিড-১৯। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস মানুষের স্বস্তি প্রায় কেড়ে নিয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবিক মূল্যবোধসহ বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশগুলোও এর প্রাদুর্ভাবের কাছে কেমন যেন অসহায়। অনেকের চোখের জল চোখেই শুকোচ্ছে। কান্না বারণ। বিষন্ন মন নিয়ে গৃহবন্দী মানুষ। বাংলাদেশ সে তুলনায় এখনও কিছুটা ভাল আছে। বড় কোন দুর্যোগ নেমে আসেনি। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা হাতেগোনা। মৃতের সংখ্যা নগণ্য। তবে এরই মাঝে অব্যবস্থাপনার নানা চিত্র সামনে এসেছে। মুখে অনেক কথা। আলোচনা। সমালোচনা। কাজের কাজ কিছু হয়েছে কি? জরুরী এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কিছুটা যেন ত্রস্ত রাজধানী। বাস্তব অবস্থা প্রত্যক্ষ করে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গেছেন। সক্ষম এবং সচেতন মানুষ গৃহবন্দী হচ্ছেন স্বেচ্ছায়। সংক্রমণ ঠেকাতে সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে যাচ্ছেন তারা। এসব কারণে ক্রমে ফাঁকা হচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। রবিবার দুপুরের দিকে গুলশান, বনানী, ফার্মগেট, হাতিরপুল, শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আগের তুলনায় মানুষ অনেক কম। অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ নেই। হুড়োহুড়ি অনুপস্থিত। রাস্তায় গণপরিবহন থাকলেও, অল্প। মহাখালীর মতো ব্যস্ত এলাকায় যানজটের দেখা নেই। গাড়ি কম। যাত্রীও। রবিউল হোসেন নামের এক তরুণ রেলক্রসিংয়ের পাশে অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু বাসে বা অন্য কোন যানবাহনে উঠছিলেন না। বিষয়টা তাহলে কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একটি প্রাইভেট ফার্মের সেলস এক্সিকিউটিভ। গুলশানে অফিস। নাখালপাড়ার বাসা থেকে আগে বাসে চড়ে চলে যেতাম। করোনার সংক্রমণের ভয়ে বাসে আর উঠি না। এখন হেঁটে অফিস করছি। একটু টায়ার্ড লাগছে। তাই এখানে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে জানান তিনি। ফার্মগেটে কথা হয় আসাদ নামের এক বাস হেল্পারের সঙ্গে। যাত্রীদের ডাকাডাকির এক ফাঁকে তিনি বলেন, যাত্রী নাই। সব করোনায় নিয়া গেছে। তারা নিজেরাও বেশি যাত্রী ওঠাতে চান না জানিয়ে বলেন, কিন্তু খরচটা তো উঠতে হইবো। এই জন্য ডাকাডাকি করতেছি। মার্কেট শপিংমলগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। খোলা কিন্তু ক্রেতা নেই বললেই চলে। বিকেলের দিকে গাউসিয়া ও নিউমার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। কেউ কেউ নিজের দোকান ফেলে রেখে অন্য দোকানের সামনে এসে গল্প জমানোর চেষ্টা করছেন। নিউমার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে ঢুকে দেখা গেল বয়স্ক দোকানি পা লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। শব্দ শুনে জেগে উঠে তিনি জানান, সারাদিনে একজন ক্রেতাও আসেনি। একজনও না। তাহলে আর খোলা কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার বন্ধ না করলে তো দোকান বন্ধ করতে পারি না। অবশ্য জাতীয় জাদুঘর, চিড়িয়াখানাসহ ঢাকার প্রায় সব বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের সামনে সাধারণ সময়ে দর্শনার্থীর দীর্ঘ লাইন দেখা যেত। এখন বন্ধ। জাদুঘরের কিপার শিহাব শাহরিয়ার জানান, করোনাভাইরাস ইস্যুতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মকর্মতা-কর্মচারীরাও সতর্কতার সঙ্গে অফিসে আসা-যাওয়া করছেন বলে জানান তিনি। ঢাকার পার্কগুলোও আগের মতো উন্মুক্ত নয়। ক্রিসেন্ট লেকে সকালে ও বিকেলে প্রচুর মানুষ হাঁটতেন। বিকেলে অনেকে বেড়াতে যেতেন। সব আপাতত বন্ধ রয়েছে। রমনা পার্ক সময় বেঁধে দিয়েছে। আগে সারাদিন খোলা থাকলেও, বর্তমানে সকাল ৬ টা থেকে ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিকেল ৪টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত ঢোকা যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত একটি নোটিস পার্কে ঝুলিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ পার্কটিও খাঁখা করছে। এ পার্কে বিদেশী কূটনীতিক, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় বিশিষ্টজনরা শরীরচর্চা করেন। বর্তমানে তাদের কেউ কেউ প্রাতঃভ্রমণ অব্যাহত রাখলেও, সামনের দিনগুলোতে তা আর সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত। আলী হোসেন মোহাইমেন নামের সাবেক এক সরকারী কর্মকর্তা বলছিলেন, ডাক্তারের নির্দেশে আমাকে প্রতিদিন হাঁটতে হয়। কিন্তু গত চারদিন ধরে আমি ঘর থেকে বের হইনি। এ কারণে শরীরে কিছু সমস্যা অনুভব করছিলাম। তাই হাঁটতে বের হয়েছি। দ্রæত হাঁটা শেষ করে বাসায় ফিরবেন বলে জানান তিনি। গল্প-আড্ডার জনপ্রিয় স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকাও সুনসান। জনমানবহীন। সব গেট বন্ধ। ভেতরে কেউ নেই। চায়ের দোকান উঠে গেছে। গল্প- আড্ডার স্থলে জায়গা করে নিয়েছে বিষণœতা। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যাদের জরুরী প্রয়োজন তাদেরও ঘরে ঢুকে পড়াটা অন্যায়। অমানবিক। এবং এমন অন্যায় কর্মও কেউ কেউ করছেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকিৎসকরা আসছেন না। এর ফলে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এমনকি সাধারণ রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন না তারা। যে ব্যক্তিগত চেম্বারে বসে কদিন আগেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গুনেছেন, সেটিতে তালা দিয়ে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলেছেন অনেক চিকিৎসক। এর ফলে দেখা দিতে পারে কৃত্রিম সঙ্কট। মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় স্বেচ্ছায় গৃহে অবস্থানকে উৎসাহিত করলেও, জরুরী দায়িত্ব যাদের তাদের দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
×