ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টিয়া বলতে পারে আপনার ভবিষ্যত! দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৪ মার্চ ২০২০

টিয়া বলতে পারে আপনার ভবিষ্যত! দায় ও দায়িত্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক সুযোগ পেলে টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনা করতে বসেন অনেকেই। কেউ কেউ বিষয়টি উপভোগ করতে চান। তেমনি টিয়া পাখি দিয়ে নিজের ভাগ্য গণনা করলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। সত্যি বলছি। এমন কা- ঘটেছে ঢাকায়। সচরাচর বড় মাপের মানুষের এমন কাজ কর্ম চোখে না পড়লেও অনেকটা কৌতূহলবশতই ঘটনাটি ঘটে গেছে। এ নিয়ে মজাও পেয়েছেন অনেকে। মূলত কৌতূহলী হয়েই টিয়া পাখির দ্বারস্থ হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এক সকালে রাজধানীর গুলশানে ‘পাড়া উৎসব’ নামের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে এ ভাগ্য গণনা উপভোগ করেন তিনি। প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে আয়োজন করা হয় এ উৎসবের। অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে মিলার দেখতে পান কতগুলো খাম ও টিয়া পাখি নিয়ে বসে আছেন এক ব্যক্তি। আর পাখিটি ওই ব্যক্তির কথামতো খামগুলো ঠোঁট দিয়ে তুলছে। এরকম ঘটনা হয়তো রাষ্ট্রদূতের চোখে ছিল একেবারেই নতুন। তাই অভিজ্ঞতা নিতে দেরী করেননি। চাকরির প্রয়োজনে হয়তো বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। কা-জ্ঞানহীন, অবৈজ্ঞানিক কাজ কারবার হয়তো কমই দেখেছেন। তাই বিষয়টির সম্পর্কে আগ্রহসহকারে পাশে থাকা মেয়র আতিকুল ইসলামের কাছে জানতে চান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। মেয়র বিষয়টি সম্পর্কে তাকে বুঝিয়ে বললে রবার্ট মিলারের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তিনি নিজেই বিষয়টি পরখ করে দেখতে চান। এ সময় খামে মোড়ানো ভাগ্য লেখা একটি কাগজ তার হাতে তুলে দেয় টিয়া পাখি। ভাগ্য গণনাকারী তখন কাগজটিতে কী লেখা আছে তা পড়ে শোনান। বাংলায় লেখা সেই চিরকুটটি রবার্ট মিলারকে আয়োজকদের একজন তা অনুবাদ করে শোনান। সেখানে লেখা ছিল, এটা যার নামে উঠবে তিনি জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করবেন। জীবনে উন্নতি ঘটবে...।’ এমন কথা শুনে প্রচ- খুশি হয়ে হেসে দেন মিলার। তিনি সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনাকারী থাকলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পথে ঘাটে এরকম দৃশ্য দেখা যায় হরহামেশাই। মূলত গুলিস্তান, আর শাহবাগেই কমবেশি পাখি জ্যোতিষীদের চোখে পড়ে। টাকার বিনিময়ে ভাগ্য গণনা করা যায় সেখানে। পাখি জ্যোতিষীদের কোন অফিস লাগে না। লাইট কিংবা ফ্যানেরও প্রয়োজন নেই। খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস আর সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা কিংবা ফুটপাথই ভরসা। একটি পাটি কিংবা কাপড় বিছিয়ে খোলা হয় ভাগ্য গণনার দোকান। এতে সরঞ্জামের খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। একটি লাঠি, একটি অথবা দুটি পাখি, কয়টি পুরনো ময়লাযুক্ত খাম, খুব বেশি হলে একটি ভাগ্য রেখার বই থাকে সঙ্গে। ব্যাস হয়ে গেল প্রস্তুতি। গত দুই দশকে ঢাকার রাস্তায় পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনার ব্যবসা অনেকটা ভালই ছিল। ইদানীং আর ভাল যাচ্ছে না। স্বয়ং জ্যোতিষীরাই আছেন ক্রেতা সঙ্কটে। তাছাড়া জ্যোতিষীদের কথাও এখন আর খুব ফলে না। তাই ভিড় কমছে। এখানে পাখি দিয়ে কতটুকু ভরসা। কম। সত্যিই কম। তাই পাখির কাছে ভিড় কমেছে হাত গণনার। মানুষ যখন মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে পারছে না এক্ষেত্রে পোষা পাখি তো অসহায় হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই পরিস্থিতিতে পেশা বদলে অনেকে অন্য কিছু করছেন। যাদের কোন উপায় নেই, বয়স হয়ে গেছে তারা পাখি নিয়েই আছেন। আরেকটি বড় বিষয় হলো যিনি রাস্তায় বসে মানুষের ভাগ্যের খবর বলে দিচ্ছেন, ভাগ্য বদলানোর কাজ করছেন তার নিজের ভাগ্য এমন কেন! যিনি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন না তিনি আবার অন্যের ভাগ্য কিভাবে বদলাবেন? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ জ্যোতিষীরা বলছেন, সহজেই পাখি পোষ মানে। এরমধ্যে টিয়া পোষ মানার ক্ষেত্রে অনেকের চেয়ে এগিয়ে। কিছু দিনের মধ্যে টিয়া কথা বলতে পারে। তাই টিয়া দিয়ে হাত গণনা শেখানো কঠিন কিছু নয়। এমন যুক্তির সঙ্গে একমত যারা টিয়া দিয়ে ভাগ্য গণনা করে থাকেন। তবে নাম প্রকাশ করে ব্যবসার ক্ষতি করতে চান না। এমনিতেই দিন ভাল যাচ্ছে না। ব্যবসা নেই বললেই চলে। তারপর যদি খবর রটে পাখি দিয়ে হাত গণনার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই, তাহলে যা আছে তাও ধস নামবে। পরিণতি হবে একেবারে শেয়ার বাজারের মতো। হেলথ এ্যান্ড হোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, পাখি দিয়ে হাত গণনার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। সাধারণত হতাশাগ্রস্ত, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ এসবে বিশ^াস করে। তারা যে কোন মূল্যে ভাগ্যের খবর নিতে চান। তাই পাখির কাছে দ্বারস্থ হন। গুলিস্তানে কাজী বশির মিলনায়তনের সামনে কথা হলো তিনজন পাখি দিয়ে হাত গণনাকারীর সঙ্গে। কারো এই বাণিজ্যের মেয়াদ ২০ বছর। কেউ ৩০ বছরের বেশি সময় এভাবেই পার করে দিয়েছেন। বেশ ভাল। এখন কি অবস্থা। মুখ দেখেই বোঝা যায়। পরিস্থিতি কেমন। হাসি নেই। একেবারে মলিন। ছেঁড়া জামা। ময়লা লুঙ্গি। পকেটে কয়েকটা বিড়ির শলা আর দিয়াশলাই। বড় চুল। সাদা দাঁড়ি বেরিয়ে গেছে বহুদিন। হয়তো কাটারও পয়সা নেই। নিজেরাই জানালেন এরকম কিছুই। বললেন, কেন জানি সাধারণ মানুষের এসবের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ নেই। দিন দিন কমছে। দিনে কমবেশি দশজনও হাত দেখাতে আসেন না। মজা বা কৌতূহলবশত দু’চারজন আসেন অনেক সময়। তারা দেখতে চান পাখির কাজকর্ম। তাই হাত দেখান। পাখিদের হাত দেখার কাজে প্রশিক্ষিতদের মধ্যে একজন আয়নাল। কথা বার্তায় বেশ তিনি। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানান। শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বাংলা-ইংরেজী মিলিয়ে কথা বলেন। চেষ্টা করেন এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ভাল মানুষরাই তা করে থাকেন, তা তিনি নানা কায়দায় বোঝাতেন। কাছে যাওয়া মাত্রই বললেই, বসুন। হাত দেখাবেন। সম্মতি পাওয়া মাত্রই নাম জিজ্ঞাস করলেন। তারপর কাঠিতে করে পাখি আনা হলো খামের কাছে। ঠোঁট দিয়ে একটি খাম উঠাল পাখি। এবার খাম থেকে বেরিয়ে এলো একটি চিরকুটের মতো। সেখানে ভাগ্যের সবকিছুই লেখা। এবার দ্বার খুলতে শুরু করল ভবিষ্যতের...। একে একে...কত কিছু। চিরকুট শেষে বিস্তারিত। এবার নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী রাশি গণনার বই থেকে। ...কিন্তু কিছুই তো আমার মিলেনি। একথা বলার পর হতাশ পাখি জ্যোতিষী। অনেকটা অবাক হলেন তিনি। বললেন, কোনদিন আমাকে একথা কেউ বলেনি। সবাই বলেছেন, বেশ ভাল। খুশি হয়েছে। হাসিমুখে ফিরেছেন সবাই। এবার ভিজিটের পালা। বললেন, ২০ টাকা। না থাকলে ১০ টাকা দেন। কথা বলতে বলতে আরও কিছু জানার চেষ্টা। বললেন, আমাদের এখানে যারা হাত দেখান তাদের বেশিরভাগ বিভিন্ন এলাকার বাসযাত্রী। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ। হয়তো গুলিস্তানে এসে বাসে নেমেছেন, নয়তো ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাবেন। আমরা নানা কায়দায় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। অনেকে উৎসাহিত হয়ে হাত দেখিয়ে যান। তাছাড়া যারা এখানে হাত দেখান তাদের মধ্যে হতাশাগ্রস্ত যুবক, যারা চাকরি ব্যবসা কিছুই করতে পারছেন না। আবার জিন, পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, অর্থ সম্পদের চেষ্টায় অনেকে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে ছুটে আসেন। বড় বিষয় হলো বিজ্ঞানের যুগে যখন করোনাভাইরাসকে জয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে গোটা বিশ^, সেখানে টিয়া পাখি দিয়ে কতদিন প্রতারণা চলবে। চীন থেকে সৃষ্ট এই ভাইরাসের কারণে বিশ^ সম্প্রদায় আজ মহাচিন্তিত। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এক দেশ থেকে অন্যদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিমান যোগাযোগ। বন্ধ হচ্ছে ভিসা। ছুটি দেয়া হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে ভাল ভাল কথা খামের ভেতরে চিরকুটে লিখে মানুষকে মানসিকভাবে দুর্বল করার অশুভ পাঁয়তারা বন্ধের কি কোন কর্তৃপক্ষ নেই। আছে। হয়তো হাজারো সমস্যার ভিড়ে এটি একেবারেই ক্ষীণ। তাই চোখে পড়ে না। এজন্য পাখি দিয়ে হাত গণনা করে এই নগরে অনেকেই দিন চালিয়ে যাচ্ছেন দিব্যি।
×