ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সহযোগিতা চাই

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা  অব্যাহত রাখতে  সহযোগিতা চাই

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ গত এক দশকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে, অগ্রযাত্রার সেই অপ্রতিরোধ্য গতি অব্যাহত রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালী সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। বিশ্বের কোথাও গিয়ে যেন বাংলাদেশ শুনলে আর আমাদের কেউ অবহেলা করতে না পারে, সেভাবেই বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আর মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখা এবং দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে তবে বাংলা ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ‘একুশে পদক-২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০ ব্যক্তি এবং এক প্রতিষ্ঠানকে এ বছরের ‘একুশে পদক’ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা বাঙালী। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি এটা যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বিস্তার লাভ করে; বিশেষভাবে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীতে এখন আর একা একটি দেশ চলতে পারে না, অন্য দেশকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয় এবং জীবন-জীবিকার জন্য অন্যভাষা শেখারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে নিজের ভাষাকে ভুলে যাওয়া, নিজের ভাষা বিস্মৃত হওয়া, এটা আমাদের জন্য মোটেই ঠিক নয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন কাজেকর্মে অনেককে ঘটনাক্রমে বিদেশে থাকতে হয়। কিন্তু, এই ভাষার মর্যাদাকে সবসময় আমাদের দিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করা। একুশ শিখিয়েছে আত্মমর্যাদাবোধ। একুশের এই রক্তের অক্ষরেই লিখে রাখা হয়েছিল আগামী দিনে আমাদের স্বাধীনতা। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। আমরা চাই এই গৌরবের ইতিহাস আমাদের দেশের প্রজন্মর পর প্রজন্ম যেন জানতে পারে। তিনি বলেন, মাতৃভাষা আন্দোলন শুধু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না, পক্ষান্তরে এটা ছিল স্বাধিকার আদায়ের, স্বাধীনতার আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতার অংশবিশেষ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ওই বক্তৃতায় জাতির পিতা বলেছিলেন- ১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার নথিগুলো সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করার উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এটা কেন করছি? তার কারণ হচ্ছে, আমি যখন দেখেছি একটার পর একটা ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম সবকিছু থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার একটা অপচেষ্টা দীর্ঘ একুশ বছর ধরে চলেছে। কাজেই আমি চেয়েছিলাম মানুষের সত্যটা জানার দরকার। আর এ সত্যটা জানানোর জন্যই আমি এই দায়িত্বটা নেই এবং এটা আজকে প্রকাশ হচ্ছে। ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যাতে মুছতে না পারে সে কারণেই গোয়েন্দা প্রতিবেদনের চার খন্ড বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। পঞ্চম খন্ড প্রকাশ হচ্ছে। মোট চৌদ্দ খন্ড প্রকাশ করা হবে। কারণ, আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস মানুষের জানা দরকার। এর মাধ্যমে আমাদের দেশের ভাষা আন্দোলনের অনেক ইতিহাসও জানা যাবে। দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার আজীবনের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ করা, লক্ষ্য পূরণ করা- এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে সবার সহযোগিতা কামনা করে সরকারপ্রধান বলেন, এই মাতৃভূমিকে আমাদের সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে। যেন বিশে^র কোথাও গিয়ে আর বাংলাদেশ শুনলে আমাদের আর কেউ অবহেলা করতে না পারে। বাংলাদেশ শুনলে যেন সবাই আমাদের সম্মানের সঙ্গে দেখে, বাঙালীকে এবং বাংলাদেশকে সেভাবেই আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গড়ে তোলেন। তাঁরই প্রস্তাবে সেই সময় ভাষা আন্দোলনের জন্য ছাত্র সমাজকে নিয়ে, অর্থাৎ তখনকার ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিসসহ আরও কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ছিল, তাদেরকে নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এটা ছিল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) ফজলুল হক হলে, ২ মার্চ। সে অনুষ্ঠানের পরেই তারা ঘোষণা দেন ১১ মার্চ হবে ভাষা দিবস। সেই ১১ মার্চ থেকে মূলত ভাষা আন্দোলন শুরু। এরপর থেকে ১১ মার্চ এই ভাষা দিবস হিসেবেও পালন করা হতো। সেই আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে, নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, সে কথাও স্মরণ করেন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা। এ সময় আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর (বঙ্গবন্ধু) এই আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়ে সবাই জানতে পারবেন জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে, সেখানেই তিনি স্পষ্টভাবে এ কথাগুলো লিখে দিয়ে গেছেন যে, কীভাবে তিনি ভাষা আন্দোলন করেন। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এক সময় তাঁর নামটা এই ভাষা আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুঝে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে ইতিহাস ইতিহাসই। সত্য কেউ মুছে ফেলতে পারে না। দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন ’৯৬ সালে সরকারে আসি, আমরা আমাদের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালন করেছিলাম। আর আজকে ২০২১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষ পালন করে যাব। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। ইনশা আল্লাহ! গত ৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের একুশে পদক বিজয়ী হিসেবে ২০ ব্যক্তি এবং এক প্রতিষ্ঠানসহ ২১ জনের তালিকা ঘোষণা করে। পদকপ্রাপ্তরা হলেন- ভাষা আন্দোলনে মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশা (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় জাফর ওয়াজেদ (আলী ওয়াজেদ জাফর), শিল্পকলায় (সঙ্গীত) বেগম ডালিয়া নওশিন, শঙ্কর রায় ও মিতা হক, শিল্পকলায় (নৃত্য) মোঃ গোলাম মোস্তফা খান, শিল্পকলায় (অভিনয়) এমএম মহসীন, শিল্পকলায় (চারুকলা) অধ্যাপক শিল্পী ড. ফরিদা জামান, মুক্তিযুদ্ধে মরহুম হাজী আক্তার সরদার (মরণোত্তর), মরহুম আব্দুল জব্বার (মরণোত্তর), মরহুম ডাঃ আ আ ম মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ-ক্বারী আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ ছাইফুর রহমান নিজামী শাহ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, অর্থনীতিতে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, সমাজসেবায় সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ভাষা ও সাহিত্যে ড. নুরুন নবী, মরহুম সিকদার আমিনুল হক (মরণোত্তর) ও কবি,সহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা বেগম নাজমুন নেসা পিয়ারি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রসূতি মায়ের জীবন রক্ষায় সায়েবা’স কীটের উদ্ভাবক অধ্যাপক ডাঃ সায়েবা আখতার। পাশাপাশি ‘গবেষণা’য় একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। পদক বিজয়ীরা প্রত্যেকে নিজে এবং মরণোত্তর পদক বিজয়ীদের পক্ষে তাঁদের পুত্র ও কন্যাগণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে পদক গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষে পদক গ্রহণ করেন এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ। বায়ান্ন’র একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মহান আত্মত্যাগ স্মরণে সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩ তোলা ওজনের ১৮ ক্যারেট সোনার তৈরি একটি স্বর্ণপদক, পুরস্কারের অর্থের চেক এবং একটি সম্মাননাপত্র প্রদান করা হয় । সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদসবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, বিচারপতিবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, সরকারের উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, পূর্ববর্তী একুশে পদক বিজয়ীগণ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও সংস্থার প্রধান এবং আমন্ত্রিত অতিথিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সমাজসেবায় একুশে পদক গ্রহণ করলেন সুফি মিজান চট্টগ্রাম অফিস জানায়, সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে একুশে পদক গ্রহণ করেছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজসেবক আলহাজ সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। সুফি মোহম্মদ মিজানুর রহমান ১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় কাঞ্চনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দায়েম উদ্দিন ও মাতা রাহাতুন্নেসা। সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। বিজনেস পার্সন অব দ্যা ইয়ার, প্রাইড অব চিটাগং, কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি এ্যাওয়ার্ড, সেন্ট মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক এ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া সরকার তাঁকে দেশটির অনরারি কনসাল হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত করেছেন।
×