ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুলন্ত তারমুক্ত হচ্ছে পূর্বাচল

প্রকাশিত: ১১:২৬, ১২ জানুয়ারি ২০২০

ঝুলন্ত তারমুক্ত হচ্ছে পূর্বাচল

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী শহর পূর্বাচল মডেল টাউনকে শতভাগ ঝুলন্ত তারমুক্ত শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। নতুন এ শহরের কোথাও চোখে পড়বে না কোন প্রকার ঝুলন্ত তার। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক শহর গড়তে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই ইলেকট্রিক ক্যাবলিং নেটওয়ার্ক সিস্টেম বাস্তবায়নের মাধ্যমে শতভাগ মাটির নিচ দিয়ে তারের লাইন প্রতিস্থাপন করা হবে। এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পূর্বাচলের কোন রাস্তা কেটে বৈদ্যুতিক কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজন হবে না বলে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। এমনকি রাস্তার মাঝে বৈদ্যুতিক খুঁটির জন্য কোন প্রকার যানবাহন চলাচলের জন্য বাধার সৃষ্টি হবে না। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করে দৃষ্টিনন্দন হবে পূর্বাচল শহরটি। সরকারের বৈদ্যুতিক প্রতিষ্ঠান ডেসকো এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে ২ বছর। তবে বর্তমান প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানের সাময়িকভাবে ওভারহেড লাইনের মাধ্যমে যেসব বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোও অপসারণ করা হবে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য রাজউক ইতোমধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে একজন চীনা কনসালটেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। শতভাগ নিরপত্তা নিশ্চিত করে যাতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায় ও এর পদ্ধতি কি তা বের করতে কাজ করতে মাঠে নেমেছে কনসালটেন্ট সংস্থা। রাজউক সূত্র বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে পরবর্তীতে ঢাকাকেও কিভাবে ঝুলন্ত তারমুক্ত করা যায় তার উদ্যোগ নেবে সরকার। বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশের প্রতিটি সড়কে প্রায় সকল ভবনের সামনে ছোট বড় হাজার হাজার তারের জটলা দেখা যায়। কোন কোন স্থানে তারের জটলা এত বেশি হয় যে, তারের জটলায় সৃষ্ট মূল ভবনও ঢাকা পড়ে যায়। কোন কোন তারের জটলার ওপর দিয়ে যে কোন মানুষ অনায়াসেই হেঁটে যেতে পারেন। তবুও জটলা থেকে তার ছিঁড়ে পরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাও থাকে না। অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এ বিষয়টি সমাধানের কোন উদ্যোগই নেয়নি কোন সরকার। এছাড়া রাজধানীর যে কোন সংস্থা তাদের ইউটিলিটি কাজ করতে গিয়ে টেলিফোন বা ডিশএন্টেনার লাইন বা বিদ্যুতের লাইন কাটা পড়ে যাচ্ছে বলে নাগরিকদের প্রতিনিয়তই বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে নাগরিক ভোগান্তিও চরমে পৌঁছে যায়। এর বাইরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। ফলে সারা বছরই কোন না কোন সংস্থার রাস্তা খুঁড়তে দেখা যায়। এর ফলে রাস্তায় যানজট বৃদ্ধি পায় ও সরকারকেও ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। রাস্তায় তারের জটলা থাকা যে কোন আধুনিক শহরের জন্য দৃষ্টিকটুও বটে। এ থেকে স্থায়ীভাবে নাগরিকদের মুক্তি দিতে ও শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে রাস্তায় তারবিহীন করতেই সরকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প দিয়েই এর সূচনা করতে চায়। এটি বাস্তবায়ন করা হলে পরবর্তীতে নতুন নির্মিত সকল সরকারী-বেসরকারী আবাসন প্রকল্পের শহরেই মাটির নিচেই সকল ইউটিলিটি লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে পূর্বাচল শহরের বিদ্যুতায়নের জন্য সড়কে সনাতন পদ্ধতিতে মাথার উপরের (ওভারহেডেড পদ্ধতিতে) ঝুলন্ত তার দিয়ে লাইন টানানোর কাজ করা হয়েছে। জানা গেছে, শহরটিকে বসবাস উপযোগী করতে প্রাথমিকভাবে এই উদ্যোগ নেয় পূর্বাচল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তবে যেহেতু পূর্বাচলকে আধুনিক শহরের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হবে তাই এ পরিকল্পনা থেকে বের হয়ে আসছে সংস্থাটি। এরই অংশ হিসেবে সরকার প্রতিটি রাস্তার নিচেই বিশেষ লাইন স্থানের নক্সা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। যেসব বড় বড় রাস্তায় প্রাথমিকভাবে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে সেসব রাস্তার একপাশে মাটির নিচ দিয়ে বিশেষ এ লাইন তৈরি করা হবে। পরবর্তীতে সকল ছোট-বড় রাস্তায়ই এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী রায়হানুল ফেরদৌস জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা পূর্বাচলকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এরই অংশ হিসেবে আমরা পূর্বাচলের রাস্তায় কোন প্রকার ঝুলন্ত তার রাখতে চাই না। এমনকি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে বর্তমানের ঢাকা শহরের ন্যায় তার ঝুলানো যাতে কেউ দেখতে না পারে সে লক্ষ্যে আমরা মাটির নিচে বিশেষ ডাক্ট তৈরি করব। কোন পদ্ধতিতে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে ও স্থায়িত্ব হবে সে জন্য একজন চাইনিজ কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে কাজও শুরু করা হয়েছে। সূত্র জানায়, অন্যান্য লাইন থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে বৈদ্যুতিক লাইনের জন্য পৃথক সার্ভিস ডাক্ট তৈরি করা হবে। এ ডাক্টের মাধ্যমে যে কোন সমস্যায় সার্ভিস প্রদানের জন্য বিশেষ পদ্ধতিও রাখা হবে। ফলে বৈদ্যুতিক গোলযোগ হলে তাৎক্ষণিকভাবেই তা সমাধান করা সম্ভব হবে। প্রকল্প সূত্র জানায়, বর্তমানের বৈদ্যুতিক লাইনের মাধ্যমে নেয়া প্রকল্পের কাজ আগামী ২০২৫ সালে শেষ হবে। এরপরই সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা হবে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকার পরবর্তী ২ বছরের মধ্যেই শেষ করতে সক্ষম হবে বলে পূর্বাচল প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। বর্তমান পূর্বাচল শহরে এখন পর্যন্ত তেমন বাড়িঘর তৈরি না হওয়ায় রাস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটির বর্তমান পদ্ধতিতেই কাজ চলমান রয়েছে। অপরদিকে পূর্বাচল শহরের মাটির নিচে সকল প্রকার ইউটিলিটি সার্ভিস লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক কর্তৃপক্ষ। তবে অন্য সকল লাইন থেকে বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগ অতি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সরকার পৃথক ডাক্ট তৈরি করবে। তবে কমন সার্ভিস ডাক্ট তৈরির ব্যয় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অন্য সকল সেবা সার্ভিস লাইন থেকে আলাদা করে বিশেষ বৈদ্যুতিক ডাক্ট তৈরি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, শহরটিতে ডিশলাইনের ক্যাবল, টেলিকমিউনিকেশনের ক্যাবল ও যে কোন প্রকার ক্যাবলমুক্ত থাকবে পূর্বাচল। সকল প্রকার ক্যাবল একসঙ্গে কমন সার্ভিস ডাক্ট তৈরি করে তারমুক্ত শহর গড়া হবে। এ জন্য পৃথকভাবে কমন সার্ভিস ডাক্ট তৈরির পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি। জানা গেছে, আধুনিক শহর গড়তে রাজউক বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিটি ভবনের ও বড় প্লটের স্থাপনায় স্যুয়ারেজ ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) স্থাপন, ছোট বড় প্রতিটি ভবনের ছাদে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম অন্তর্ভুক্তকরণ, পানির জন্য প্রিপেইড মিটার চালু করারও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যার কাজও শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৪ নবেম্বর ২০১৯ তারিখে এ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় রাজউকের সদস্য (প্রশাসন) কমিটিকে জানায় যে, পূর্বাচল প্রকল্পের পূর্ণপ্রস্থে রাস্তা নির্মাণকালীন ইলেকট্রিক ক্যাবলিং নেটওয়াক সিস্টেম বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে জানা গেছে, বর্তমানের প্রকল্পের রাস্তার জন্য রাখা জমির পুরোভাগেই সড়ক পাকা করা হচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে সড়কের জন্য রাখা পূর্ণ জমিতে সড়ক নির্মাণ করার সময় অবশ্যই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেই কেবল রাস্তার কাজ সমাপ্ত করা হবে। মূলত পরবর্তী ৫০ বছর যাতে বৈদ্যুতিক কাজের জন্য বা যে কোন ইউটিলিটি কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করতে না হয় তাই এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক উজ্জল মল্লিক জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের কোন আধুনিক শহরে এই প্রথমবারের মতো আমরা শতভাগ মাটির নিচ দিয়ে বিশেষ ডাক্ট তৈরির মাধ্যমে শহরটির প্রয়োজনীয় সকল তার (ক্যাবল) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ উদ্যোগটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আমরা কোন কোন স্থানে কি পদ্ধতিতে এই বৈদ্যুতিক লাইনসহ সকল সার্ভিস লাইনের ক্যাবল নেয়ার ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এছাড়া বর্তমানে থাকা সকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল ও খুঁটি উঠিয়ে নেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, পূর্বাচলকে দেশের সর্বাধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা চাই এ শহরটির মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলা কোন নতুন শহর যা হবে শতভাগ ঝুলন্ত তারমুক্ত। অর্থাৎ এ শহরের কোথাও কোন তার চোখে পড়বে না। সকল তারের লাইন প্রতিস্থাপন হবে মাটির নিচে বিশেষভাবে তৈরি ডাক্টের ভেতর দিয়ে। সম্প্রতি পূর্বাচল প্রকল্পের পূর্ণপ্রস্থে রাস্তা নির্মাণকালীন ইলেকট্রিক ক্যাবলিং নেটওয়াক সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে রাজউককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ডিশ লাইন, টেলিফোন লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন ছাড়াও সকল প্রকার তারের জঞ্জালমুক্ত হবে এ পূর্বাচল শহর। নতুন এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। শতভাগ নিরপত্তা নিশ্চিত করে যাতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায় ও এর পদ্ধতি কি তা বের করতে কাজ করতে মাঠে নেমেছে কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানটি। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইউটিলিটি সার্ভিস লাইন মাটির নিচ দিয়ে থাকবে বিধায় আশা করি আগামী ৫০ বছর যাতে বৈদ্যুতিক কাজের জন্য বা যে কোন ইউটিলিটি কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে না। ফলে নতুন শহরের প্রতিটি রাস্তাই হবে বর্তমান ঢাকার চেয়ে খোঁড়াখুঁড়িমুক্ত রাস্তার শহর। যার ফলে জনভোগান্তি অনেকাংশে কমে আসবে।
×