ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত নাদিরা মজুমদার

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ৩ জানুয়ারি ২০২০

অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারে  ভূষিত নাদিরা মজুমদার

১৯৯৩ সাল থেকে চালু হওয়া অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার সৃজনশীল ধারার লেখকরাই পুরস্কার পেয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রথা ভেঙ্গে এবার ২০১৯ পুরস্কার পেয়েছেন বিজ্ঞান লেখক নাদিরা মজুমদার। বিষয়টি অবশ্যই নানা দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও বহুমাত্রিক ব্যাঞ্জনায় লালিত। পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকাটি এটা উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে যে নারীরা নিজের যোগ্যতা প্রমাণে তারা তখনই স্বতঃস্ফূত হয় তখন তারা একটি নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্ম পায়। এই পর্যন্ত এই পুরস্কার পেয়েছেন ২৫ জন সৃজনশীল ও মননশীল নারী। শুধু সাহিত্য পুরস্কার নয় এর পাশাপাশি পত্রিকাটি ‘শীর্ষ দশ’ পুরস্কার প্রদান করে আসছে। এই ক্ষেত্রে নারী অধিকার কর্মী, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, রাজনীতিসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই সব নারীকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। যা নারীকে আত্মসচেতন করেছেন। কেউবা জীবনের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় দায়বদ্ধ হয়েছে। তাই অনন্যা শুধু একটি পত্রিকা নয় এর ব্যাপ্তি, প্রজ্ঞা ও মননের ভিত্তি অনেকটা গভীরে। অনন্যার এই বিষয়গুলোর প্রতি সবাই কৃতজ্ঞ। যা অনন্যার নিজস্ব উদ্যোগের একটি সার্থক পেক্ষাপট। বাংলা ১৪০১ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। ১৪২৬ সালে এই ‘অনন্যা সাহিত্যপুরস্কার’ পেলেন লেখক নাদিরা মজুমদার। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। গত ২৯ ডিসেম্বর, রবিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম। সভাপতিত্ব করেন সমাজসেবক মালেকা খান। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় নাদিরা মজুমদারের ওপর সাংবাদিক-নির্মাতা তাপশ কুমার দত্তের একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে। পুরস্কার প্রদান পর্বে নাদিরা মজুমদারকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সভাপতি মালেকা খান। তাঁর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধান অতিথি ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সনদ ও সম্মাননা অর্থ হিসেবে এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন বিশেষ অতিথি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম। নাদিরা মজুমদার তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, বিশুদ্ধ সাহিত্যের গন্ডিকে ভেঙে দিল অনন্যা। আজ এই মঞ্চে নন-ফিকশনধর্মী বিজ্ঞান ও রাজনীতিবিষয়ক লেখাকে সাহিত্যের অংশ হিসেবে সম্মানিত করে সাহিত্যের মহত্ত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বিজ্ঞান-সাংবাদিকতায় নতুন দিক উন্মোচন করেন নাদিরা। তিনি সত্তর দশকে সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করতেন। শ্রেণীকক্ষে আমি তাঁকে বিজ্ঞানবিষয়ে পাঠদান করলেও তাঁর কাছ থেকে আমি জেন্ডারবিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি। আলোচনাপর্বে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৩২ বছর ধরে অনন্যা একটা বড় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাসমিমা হোসেনকে অভিনন্দন জানাই। তিনি নানা প্রতিকূল অবস্থায় পত্রিকাটি টিকিয়ে রেখেছেন। পুরস্কৃত লেখক সম্পর্কে তিনি বলেন, নাদিরা ভিন্নধারার লেখক। তিনি বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়টি বাংলা ভাষায় নিয়ে এসেছেন। বিদেশে থাকলেও তাঁর বিজ্ঞানচর্চার ফল পাচ্ছি আমরা। তাঁর অনুসন্ধানী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের নানানভাবে সমৃদ্ধ করেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, আমরা একটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করি। নাদিরা এই গন্ডিকে ভেঙেছেন। বাংলা বাজারের মেয়েটি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নীরব বিদ্রোহ করে যাচ্ছেন। সভাপতির ভাষণে মালেকা খান বলেন, বিজ্ঞান আমাদের আয়ত্ত করা দরকার। বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। নাদিরার মতো বিজ্ঞানমনষ্ক হতে হবে। উল্লেখ্য, নাদিরা মজুমদার অনেক বছর ধরে চেক প্রজাতন্ত্রে বসবাস করছেন। জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ মে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি ছিলেন এ্যাকাউন্ট্যান্ট, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজার, চেক প্রজাতন্ত্রের নীতি-নির্ধারক ইত্যাদি। প্রাগস্থ জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনের বহিরাগত কনসালট্যান্টও ছিলেন। নাদিরা মজুমদারের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে : ‘এই আমাদের পৃথিবী’, ‘একমেরু বনাম বহুমেরু’, ‘মহাবিশ্বে আমরাও আছি’, ‘বিমান’, ‘কৃত্রিম উপগ্রহ’, ‘আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের কাহিনী’, ‘নানারঙের বিজ্ঞান’, ‘আইনস্টাইন সুপারস্টার’, ‘সময়, তুমি কে?’ ইত্যাদি। বাংলা ১৪০১ সাল (১৯৯৩ সাল) থেকে অনন্যা সাহিত্যপুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবছর একজন নারী-সাহিত্যিককে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ-পর্যন্ত যাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা হলেন- সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, নীলিমা ইব্রাহিম, দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, সন্জীদা খাতুন, শহিদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), নূরজাহান বেগম, রাজিয়া খান, রুবী রহমান, পূরবী বসু, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মকবুলা মনজুর, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ, সালেহা চৌধুরী, নূরজাহান বোস, মালেকা বেগম, কাজী রোজী, নিয়াজ জামান, জাহানারা নওশিন, সোনিয়া নিশাত আমিন, বেগম আকতার কামাল, বেগম মুশতারী শফি ও আকিমুন রহমান। নারীদেরকে অনন্যা যে প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছে তাতে অনুপ্রাণিত দেশের প্রতিটি নারী। মুগ্ধ দেশের প্রতিটি মানুষ। তবে বিষয়টি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারলে নারীদের উত্তরণের পথটি আরও সাবলীল হবে, তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে পারবে। অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেনের প্রতি রইল আমাদের কৃতজ্ঞতা।
×