ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

নির্ভার হোক দেশের উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৮ নভেম্বর ২০১৯

নির্ভার হোক দেশের উন্নয়ন

কয়েকদিন ধরে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। ১৫ আগস্টে জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ড, এমনকি তাঁর পরিবার-আত্মীয়স্বজনদের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনা এখনও আমাকে ব্যথিত করে। মনে আছে আমাদের কুমিল্লার বাসায় আমার পিতা প্রফেসর মোহাম্মদ মোবাশ্বের আলী কয়েকজনকে নিয়ে গোপনে শোক প্রস্তাব করেছিলেন। পরেরদিন থেকেই টিকটিকি লেগে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ৩ নবেম্বরে চারজন জাতীয় শীর্ষ রাজনীতিককে খুনী চক্র মোশতাক-জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে হত্যা করল। প্রশ্ন এখনও ঘুরপাক খায় মনে, খালেদ মোশাররফরা কেন ১৫ আগস্টের পরই প্রতিরোধ গড়ে তুলল না? মোনাফেকরা জাতির যে সম্ভ্রমহানি জাতির পিতার হত্যার মধ্য দিয়ে করেছে তার বিচারের জন্য কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভেজালমিশ্রিত কতিপয় ব্যক্তি সমাজ ও জাতির ক্ষতি করছে এখনও যখন দেশ আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নত হচ্ছে, মানুষের মধ্যে আত্ম সচেতনতা বেড়ে উঠেছে। এই সমস্ত উঁইপোকা যেন দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দোসর ও মদদদাতাদের বাংলার মাটিতে স্থান হবে না। তাঁর এ প্রত্যয় বাস্তবায়নের কাজটি কেবল বর্তমান প্রজন্ম নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মকেও করতে হবে। এদেশ হবে শান্তির দেশ। উন্নত জীবনমান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যাতে মানুষের মধ্যে আয় প্রবাহ সৃষ্টি করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বুয়েটে সম্প্রতি যা ঘটে গেল তাতে অবশ্যই বিএনপি-জামায়াতের এক ধরনের শিক্ষক-শিক্ষিকার মদদ রয়েছে। আবরারের হত্যাকান্ড অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এর পাশাপাশি যেভাবে একশ্রেণীর শিক্ষক রাজনীতি করেছেন তা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। আশ্চর্য ও স্তম্ভিত হয়ে গেছি বুয়েটের এক অধ্যাপকের নাগরিক টিভিতে বক্তব্য শুনে। তিনি যেভাবে কথা বলছিলেন টকশোতে যেন তারেক জিয়ার প্রেতাত্মা তার কাঁধে ভর করেছিল। আসলে ছাত্র রাজনীতি হবে ছাত্রদের কল্যাণের জন্য। এক্ষেত্রে ধামাচাপা দেয়ার কোন কাজ নেই। যখন দেশে ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তখন কেউ ছাত্রলীগকে বিপদে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে কি না, সেটি গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখতে পারেন। অন্যদিকে বার বার কোটা সিস্টেম পরিবতন হয়েছে। কারা বিএনপি-জামায়াতীদের পক্ষে কাজ করেছিল, খুঁজে বের করা দরকার। বারবার যড়যন্ত্রকারীরা পার পেয়ে গেলে আখেরে আবার ষড়যন্ত্র করতে পারে। জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথার্থ উক্তি বারংবার কানে বাজে, ‘খুনীদের জন্য এত মায়াকান্না কেন?’ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত উক্তিটি আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। বস্তুত বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। অপ্রতিরোধ্য এ অগ্রযাত্রায় সময় সময় কিছু অযোগ্য লোক ‘কাউয়ার মতো’ আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে থাকে এবং ঘুণে পোকার মতো ধীরে ধীরে কাটতে থাকে। এরা হচ্ছে ঘর শত্রু বিভীষণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকগুলো যখন সব সময়ই উর্ধমুখী, সে সময় ভূগর্ভস্থ অর্থনীতির কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্রেক হয়। সরকারপ্রধান এ ব্যাপারে বারংবার হুঁশিয়ারিই কেবল দিচ্ছেন না, বরং দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের মতো ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশে দৃশ্যত না থাকলেও তার বাড়িতে ক্যাসিনো ও মদ্যপানের সুব্যবস্থা রেখেছিলেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এদিকে দেশের বেসরকারী বিনিয়োগ ব্যবস্থা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। বেসরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে দেশে বিনিয়োগ করার মতো পরিবেশ এবং ব্যাংকারদের নতুন উদ্যোক্তা তৈরির অভ্যাস গড়তে হবে। একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, গায়ের রং গিরগিটির মতো বদলিয়ে ফেলে। তারা বিএনপি-জামায়াত বা বাম গ্রুপের অনুসারী হলেও মুখে মায়াবিয়া-এজিদের মতো বর্তমান সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে; কিন্তু তলে তলে ইঁদুরের মতো বেড়া কাটতে থাকে। এই বিনিয়োগ একটি স্থানে থমকে দাঁড়ানোয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ক্ষতি হচ্ছে। আবার তেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। যেখানে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাই চাকরি পাচ্ছে না, সেখানে বিদেশ থেকে মানুষ ধরে এনে কাজ দেয়া হচ্ছে। ফলে দেখা যায় অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আমরা যেমন পঞ্চম, তেমনি এ দেশ থেকে অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধমে অর্থ চলে যাওয়ায় বারোতম। এটি আসলে দেশে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, আমলা, শিল্পপতি ও উদ্যোক্তাদের ‘মাফিয়া নেক্সাসে’র কারণে এমনটি হচ্ছে। আর এ সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও ঘুষ একই অঙ্গে বহুরূপ-আমাদের দেশকে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন থেকে পেছনের দিকে ধাবমান করছে। যে উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকার নানা কর্মযজ্ঞ বিশালভাবে করছে তা আরও বেগবান হতো যদি ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি না থাকত। শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সর্বক্ষেত্রেই আমরা ভাল করছি। কিন্তু ক্যাসিনো কান্ডের পর প্রমাণ হচ্ছে জননেত্রী যথার্থই তার ঘরকে সুসংহত ও দুর্নীতিমুক্ত করতে চাচ্ছেন। আর ব্যাংকাররা যেভাবে লোক দেখানো আইনকানুন করে সাধারণ মানুষের টাকা না রাখার জন্য দশ থেকে ত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত কেওয়াইসি (কণঈ) ফরম তৈরি করেছিল তাতে ভূগর্ভস্থ অর্থনীতিই কেবল শক্তিশালী হয়েছে। প্রফেসর ড. আখলাকুর রহমান দেখিয়েছিলেন যে, যা ধরা পড়ে তার বিশ গুণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ অর্থনীতির আওতায়। মনে আছে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে কেওয়াইসি ফরমটির প্রচলন শুরু করা হয়। এটি দিন দিন কেবল সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি বিমুখ করে তুলেছিল। সাধারণ মানুষকে নিয়ে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রাক্তন গবর্নর দশ টাকা দিয়ে হিসাব খোলার পথ দেখিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত উন্নয়নমালাকে অনুসরণ করা দরকার। জননেত্রীকে হত্যা করার চক্রান্তে জাতীয় কলঙ্ক তারেকের নেতৃত্বে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে কেবল চক্রান্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং বিভিন্ন কায়দায় আমরা যারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করি তাদের নিপীড়ন-নির্যাতন-গুম বিএনপি-জামায়াতী আমলে করা হয়েছে। এমনকি এরশাদ আমলেও খুব একটা ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমাদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর ৩ নবেম্বরের ঘোষণা ‘বঙ্গবন্ধুর খুনী, ৩ নবেম্বরের জেল হত্যাকান্ড এবং যুদ্ধাপরাধীদের যারা দোসর ও পেছনের নেপথ্য নায়ক ছিল তাদের বিচার এবং মুখোশ উন্মোচন যেন ভবিষ্যতে করা হয়।’ আসলে এদের মুখোশ উন্মোচন করে শাস্তি দিতে পারলে দেশের শান্তি, উন্নয়ন, প্রগতি ও অগ্রগতি সাধিত হবে। ক্ষমতাতন্ত্রের কাছাকাছি যারা ভন্ড আওয়ামী লীগার হয়েছেন তাদের মুখোশ উন্মোচন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। জননেত্রী সারাদেশে চলমান সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী কর্মকান্ডকে বহমান রাখার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তাতে জনগণ খুশি হয়েছে। আশা করা যায়, দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। বরং এ অর্থ অর্থাৎ পুঁজি যদি কৃষি ও শিল্প-কলকারখানায় বিনিয়োগ করা যায় তবে দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে। কেননা কেবল কর্মসংস্থানই পারে মানুষের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি করতে। দেশে ধনীদের হার গরিবদের তুলনায় ১১৯ গুণ বেড়ে যাওয়াটা বেমানান। বরং সরকার যে সেফটি নেটওয়ার্ক চালু করেছে, গ্রামকে নগরায়ণ করার চেষ্টা করছে, সেটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। কাজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই সততা ও দলের প্রতি ভালবাসা থেকে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। আসলে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উত্থান সেটি দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখতে হবে। সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক কেবল প্রশংসা করেনি, বরং চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বিশ্বব্যাংক রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে। রাজনৈতিক সমাধানে ইতোমধ্যে ভারত বাংলাদেশের পাশে আছে বলে জানিয়েছে। মিয়ানমার কি তাদের দেশের বৈধ নাগরিকদের ফেরত না নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে না? বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়ে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে যে কোন মূল্যে। একটি দেশের উন্নয়নের স্তম্ভ হচ্ছে শিক্ষা। ডেমোগ্রাফিকের ভিত্তিতে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। তবে দেশে এখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে সৃজনশীল শিক্ষা প্রশ্ন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা পাঠ্যবইতে ‘উদ্যোক্তা অর্থনীতি’র ওপর দুটি নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নচেৎ ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরির কোন সহজ পথ নেই। এ দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, সমবায়ভিত্তিক ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, আমার বাড়ি আমার খামার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে সিপিডির মূল্যায়নটি বড় বেশি একপেশে ও নেতিবাচক। উন্নয়নের যে প্রারম্ভিক মূল্যায়ন তারা করেছে এক কথায় বলা চলে রাজনৈতিকভাবে তা ভিন্ন মতাদর্শের। যখন কোন দেশের উন্নয়ন হয় তখন সমস্যা থাকবেই। এটি গাণিতিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করে বরং আচরণগত অর্থনীতি বা ইবযধারড়ঁৎরধষ ঊপড়হড়সরপং-এর মাধ্যমে সমাধানের কৌশল অর্থ মন্ত্রণালয়কে খুঁজতে হবে। মূল স্রোতধারার অর্থনীতিতে যেখানে মানুষকে ধরা হয় রেশনাল হিসেবে, সেখানে কিন্তু আচরণগত অর্থনীতিতে ধরা হয় ইরেশনাল হিসেবে। একটি প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্য যথার্থ সিদ্ধান্ত কিভাবে হতে পারে, কেন আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আচরণগত অর্থনীতিকে জোর দেয়া হচ্ছে সেটা বুঝতে হবে এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। লেখক : অধ্যাপক এবং ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়্যাল ইকোনমিস্ট। [email protected]
×