ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ফিরে দেখা ইতিহাস ও আমাদের দায়

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ৫ নভেম্বর ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ফিরে দেখা ইতিহাস ও আমাদের দায়

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতিকে পিতাহীন করার পর ঘাতকরা বুঝে যায় এখনও কিন্তু বাংলার আশা-ভরসা মিলিয়ে যায়নি। তারা খুব ভাল করে জানত চার জাতীয় নেতার একজন বেঁচে থাকলেও ঘটনা সামাল দেয়ার পাশাপাশি মোড় ঘুরে যাবে। বিশেষত সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীন আহমদকে ভয় পেত তারা। ভয় পাবারই কথা। তাঁরা দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তাঁরা পাকিস্তান, চীন, আমেরিকার মতো বড় বড় দুশমনদের সামাল দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রজ্ঞা আর মেধার পাশাপাশি নেতৃত্ব দেয়ার যে ক্ষমতা তা বাংলার মানুষ জানে। বিশ্বাস করে। তাই তারা সময় নষ্ট করেনি। আজ এ কথা বলতেই হবে, সে রাতেই বাংলাদেশ মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে। আজ আমরা যে আওয়ামী লীগ দেখছি সেদিন তা ছিল না। সে সময় তাদের নামও বলা যেত না। যেসব নব্য রাজাকার আর স্বাধীনতাবিরোধী টকশো বা মিডিয়ায় আস্ফালন করে তারা ভুলে যায় তাদের এই চেহারা দেখানো বা কথা বলার অধিকার দিয়েছিল কারা। তাঁরা না থাকলে পাকিদের গোলামি আর বালুচদের মতো জীবনভর কাঁদতে হতো আমাদের। আজ যারা শেখ হাসিনার নিন্দা বা সমালোচনায় মুখর তাদের কাছে জানতে চাই, আপনারা যাবতীয় শোক কষ্ট মৃত্যুর জন্য এত মরিয়া বিচারের সমালোচনায় আকাশ বাতাস ভারি করে তোলেন, কই একবারও কি জানতে চান ৩ নবেম্বরের বিচার শেষ হয়েছে কি না? শেখ হাসিনা আছেন বলেই আজ বুক ফুলিয়ে কথা বলছেন। অথচ একটুও কৃতজ্ঞতা নেই আপনাদের। ভুলে যান এই চার জাতীয় নেতার পরিবার পরিজন কি দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছিল! ভুলে যান এসব মানুষ ছিলেন নিরপরাধ আর অনুগত। তাই তাঁদের পৃথিবী ও সভ্যতার সকল নিয়ম ভেঙ্গে জেলাখানায় হত্যা করা হয়েছিল। আমার বাবা ছিলেন খুব সাধারণ মানুষ। চাকরি সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তার রাজনীতি নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। মা বলেছিল গান্ধীজীকে মেরে ফেলাটা বাবা মানতে পারেননি। একদিন এক রাত না খেয়ে অনশন করেছিলেন নিজের মতো। বাবার মুখে ভয় দেখেছি পঁচাত্তরে। দেখেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুব বিষণœ ও হতাশ। কিন্তু যে রাতে তাঁদের হত্যা করা হলো বাবাকে দেখলাম উদ্বিগ্ন আর বিচলিত। এ ঘর ও ঘর করে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। বারবার বলছিলেন, এ দেশে আর কোনদিন নেতা জন্মাবে না। তাঁদের মতো মানুষকে মেরে ফেলার অভিশাপ এই জাতিকে ক্ষমা করবে না। এখন বুঝি সাধারণ মানুষের অসাধারণ দৃষ্টি কাকে বলে। তাঁদের হত্যা করার পর এই দেশে আর কোন নেতা জন্মেছে? খেয়াল করবেন আজ পর্যন্ত আর তেমন কোন নেতা আসেননি। বরং নেতার নামে অভিনেতা আর ঠগ-বাটপাড়ে ভর্তি রাজনীতি। এককালে প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিংয়ের যে রাজনীতি তা শেষ হয়ে গিয়েছিল চার জাতীয় নেতার হত্যাকা-ে। সেদিক থেকে খুনীরা সার্থক। তারা যা চেয়েছিল তাই হয়েছে। আজ দেশে নেতৃত্ব প্রায় নেই। নেতার অভাবে রাজনীতির যে করুণ দশা তার মূলে এই হত্যাকা-। এখনও এর সঠিক বিচার কেন হয়নি? তার কারণ তো অজানা নয়। জানা উচিত সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ আর কামারুজ্জামান, মনসুর আলীরা কেমন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন! সে কি কাল! সবাই বাকশালে যোগ দিচ্ছে। এমনকি জিয়াউর রহমানও যোগ দিয়েছিলেন। সবাই এমন ভাব দেখালেন যে, বঙ্গবন্ধুর বিপ্লব শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা বাড়ি ফিরেবেন না। অথচ অন্যদিকে চলছিল ষড়যন্ত্র। চার নেতাকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল কে জানেন? তাঁদের দলের নেতা, মাত্র সাড়ে তিন বছর আগেও যে ছিল তাঁদের বন্ধু বেশি শয়তান। সেই বিশ্বাসঘাতক বেঈমান মোশতাকের বুক কাঁপেনি জেলখানার গেট খুলে দেয়ার আদেশ দিতে। কি ভয়ঙ্কর! তাঁদের অপরাধ তাঁরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা দিয়ে দেশ শাসন তো দূরের কথা, বঙ্গভবনেও যেতে চাননি। সবার মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ব্যতিক্রম। এমনকি মৃত্যুর ব্যাপারেও। এই মানুষটি যে ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি দেশটির জন্মলগ্নে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা নতুন প্রজন্ম তেমন জানে না। কত মিথ্যা, কত ষড়যন্ত্র আর ছলনা। মোশতাক বাইরের দেশে গিয়ে পাকিদের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেবে এমন গুজব বাজারে। তখন ইন্দিরার একান্ত সচিব ছিলেন ডিপি ধর। এই ধর বাবুকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতেন তিনি। এমনও শোনা যায়, শেষদিকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আর কৌশল বজায় রাখার জন্য দিল্লী তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আর কাউকে অনুমতি দিত না। ’৭১ সালে কলকাতায় একদিকে যেমন মুক্তির জন্য লড়াই, আরেকদিকে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা সেই অভয়ারণ্যে মজা নিতে ব্যস্ত। তাদের বিলাস আনন্দ নারীসঙ্গ ছিল কাহিনী। তিনি তখন পরিবারের সঙ্গে না থেকে অফিসের মেঝেতে ঘুমাতেন। কোন বিশেষ বাহিনীর পরিবর্তে মুক্তিবাহিনীর নামে যুদ্ধ পরিচালনা করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে যে কতবার বিপদে ফেলেছে। নিজেদের লোকেরাই মাথা গরম করে বন্দুক নিয়ে গেছে মেরে ফেলার জন্য, পারেনি। মারল স্বাধীন দেশের কিছু খুনী জওয়ান। গত বৃহস্পতিবার সারাদিন ঢাকায় ছিলাম। রাত দুপুরে ফ্লাইট বলে কোথাও বের হইনি। তবে একটি তীর্থস্থান মিস করিনি। বিষণœ অপরাহ্নে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল আলিসান সব গাড়ি। চোখ খুললেই সুরম্য আকাশচুম্বী অট্টালিকা। দুনিয়ার যে কোন শহরের তুলনায় লেভিস চাকচিক্যময় দেশের লোকজন কি জানেন বনানীর ঘাসে ঢাকা ছোট কবরটিতে শুয়ে আছেন এ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। যাঁর ত্যাগ ও বিচক্ষণতা ছাড়া এ দেশ স্বাধীন হতো না। সারাজীবন সাদা হাফ হাতা শার্টের এই মানুষটির সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে শুভ্রতা ও স্বচ্ছতার রাজনীতি। বাংলাদেশকে চার জাতীয় নেতা উপহার দিয়ে গেছেন বিশ্বাসের রাজনীতি। তাজউদ্দীন নাকি তাঁর পরিবারের লোকজনকে বলেছিলেন, মুজিব ভাই তাঁকে ডাকছে। বলছেন চলে আয়। তোকে ছাড়া ভাল লাগছে না। আহা রে ইতিহাস। যে মানুষটি জীবদ্দশায় পর হয়ে থাকল, যাঁকে মোশতাক গং কাছে ভিড়তে দিল না, আশ্চর্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধুরও সময় হলো না একবার তাঁর কথা শোনার। সেই মানুষটার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে খুনীরা এমনভাবে গুলি চালিয়েছিল, মনে হতে পারে তারা কোন শত বছরের দুশমন খুঁজে পেয়েছে। মেরেও তারা শান্তি পায়নি। লাশ নেড়েচেড়ে দেখেছে আছে কি নেই। জেলখানার মতো নিরাপদ জায়গা, যেখানে লেখা থাকে রাখিব নিরাপদ, সেখানে জেলারের অসম্মতিতে জোর করে মীরজাফর বেঈমান মোশতাকের অনুমতি নিয়ে চার নেতাকে হত্যা করা হয়। আজকের প্রজন্ম কি তা জানে? তাঁরা স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। আমাদের পতাকা সঙ্গীত ভূমি দিয়েছেন; কিন্তু আমরা তাঁদের বাঁচতে দেইনি। এই কৃতঘœতা কি ইতিহাস বা সময় মাফ করবে? যতদিন এর সুষ্ঠু বিচার এবং ইতিহাসে তাঁদের আলো এসে না পড়বে, যতদিন তাঁদের একটু হলেও ছোট করে রাখা হবে, ততদিন রাজনীতির মুক্তি নেই। বাঙালী যেন তাদের দায় ও কর্তব্য ভুলে না যায়। তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। [email protected]
×