ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিলমারীতে উন্নয়নের টাকা হরিলুট

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ১ অক্টোবর ২০১৯

চিলমারীতে উন্নয়নের টাকা হরিলুট

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ চিলমারীতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচীর নামে বরাদ্দের টাকা হরিলুট। সিংহভাগ এলাকায় কাজ না করেই বিল উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। একসঙ্গে একাধিক প্রকল্পসহ সীমিত সময় এবং জুনের মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করাকেই দায়ী করছেন জনপ্রতিনিধিগণ। জেলার তিস্তা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় চিলমারী উপজেলায় রয়েছে ৬টি ইউনিয়ন। দারিদ্র্যপীড়িত এই উপজেলায় সরকারীভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে ১ম ও ২য় পর্যায় টেস্ট রিলিফ (টিআর)-৮৭টি প্রকল্পে ১২ কোটি ৪৮ লাখ ২ হাজার ৯০১ টাকা, কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা)-১৩টি প্রকল্পে ৪ কোটি ৫২ লাখ ৪ হাজার ১০০ টাকা এবং কাজের বিনিময় খাদ্য (কাবিখা)-৮টি প্রকল্পে ৩১ লাখ ৩৫ হাজার ২১ টাকা ও ১৪টি প্রকল্পে ২৩৬ দশমিক ৮৬০২ মে.টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। অভাবী আর নদের ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, থানাহাট ইউনিয়নের চিলমারী মডেল থানার সামনে নুরুল হকের পুকুরপাড় হতে বাড়ি মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ১ লাখ ২৮ হাজার ২০০ টাকা এবং মাটিকাটা নূরানী মাদ্রাসা হতে ওমর হাজীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর উদনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ভরাটের জন্য ৭০ হাজার টাকা, সোনবোন পাড়া পাকা রাস্তা হতে ইয়াকুবের বাড়ি পর্যন্ত ৭৩ হাজার ৭০০ টাকা, ময়জুদ্দি মেম্বারের বাড়ি হতে বৈরাগীরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ৭৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কোন কাজই করা হয়নি। অথচ কাগজ-কলমে কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে জুনের মধ্যেই বিল উত্তোলন করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা মোকছেদ, মজিবর, আমেনা বেগম বলেন, ব্র্যাক মোড় হতে রেলক্রসিং পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা এবং অধিকারী পাড়ার হতে পূর্বদিকে মকবুলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৪৩ হাজার ২৮০ টাকা করে বরাদ্দ দিলেও এখানে এক কোদাল মাটি কাটা হয়নি। রাস্তা থেকে রেলক্রসিং উঁচু হওয়ায় প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। নুরুল হকের পুকুরপাড় হতে মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের নামে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা স্থানীয়রা কেউ জানেন না স্থানীয় বাসিন্দা আকবর আলী, শমসের মিয়া, ফজলু মিয়া অভিযোগ করেন। তারা বলেন, প্রচার না থাকায় স্থানীয়রা জানতে পারে না। যার কারণে মাঠ পর্যায় কাজ না করেই প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের লোকজন আঁতাত করেই সরকারের উন্নয়নের টাকা আত্মসাত করছেন। ফলে সরকার উন্নয়ন করলেও এর সুফল মাঠ পর্যায়ের মানুষ পায়না। মাটিকাটা নূরানী মাদ্রাসা হতে ওমর হাজীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের কোন কাজ হয়নি বলে জানান ওমর হাজী। বন্যার সময় পানি উঠলেও তার আগে ও পরে এই রাস্তার কোন কাজ করা হয়নি। তবে স্থানীয়রা বলেন, নিজেরা চাঁদা তুলে বন্যার পরে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করেছে। এখানে কোন সরকারী বা বেসরকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। রানীগঞ্জ ইউনিয়নের সোনবোন পাড়ার বাসিন্দা ইয়াকুব আলী বলেন, আমার বাড়ি হতে সোনবোন পাড়ার পাকা রাস্তা পর্যন্ত কোন কাজ হয়নি। এখানে বরাদ্দ এসেছে আমরা জানিই না। চর উদনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবলু মিয়া জানান, আমার স্কুলে ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার কান্ট্রি প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে মাটি কেটে দিয়েছিল। কিন্তু টিআর প্রকল্পে মাঠ ভরাটের নামে যে ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেই টাকার মাটি কাটা হয়নি। আমি নিজেও জানিনা আমার স্কুলের নামে মাঠ ভরাটের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের বিষয়ে আপনাদের কাছেই প্রথম শুনলাম। বৈরাগীরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন বলেন, ময়জুদ্দি মেম্বারের বাড়ি হতে স্কুলের রাস্তা মেরামতের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই রাস্তা সংস্কার হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনপ্রতিনিধি বলেন, যে টাকা বরাদ্দ আসে সেই টাকার কমিশন দিতে হয় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা-কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাই সব কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়না। তারা আরও বলেন, সরকারের একাধিক প্রকল্প আসে বছরের মাঝামাঝি সময়। যা অল্প সময়েই শেষ করার নির্দেশ থাকে। প্রকল্প শেষ হতে না হতেই বন্যা চলে আসে। ফলে অনেকেই নামকাওয়াস্তে বন্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় কাজ করলেও পরে বন্যায় ক্ষতি দেখানো হয়। তবে তারা জানান, নজরদারি বাড়ানোসহ বছরের শুরু এবং বন্যার পরে প্রকল্প দিলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে আসবে বলে তারা জানান। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে থানাহাট ইউনিয়নে টিআর-২৮টি প্রকল্পে ৪ কোটি ৫২ লাখ ১ হাজার ৩১০ টাকা। কাবিখা প্রকল্পে ১৩০.৬৫৪ মে.টন গমসহ ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯১ টাকা। কাবিটা-৩টি প্রকল্পে ১ কোটি ২২ লাখ ৮ হাজার ১৫০ টাকা। রানীগঞ্জ ইউনিয়নে টিআর- ১৬টি প্রকল্পে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮ হাজার ৩২৭ টাকা। কাবিখা প্রকল্পে ১৬.৪১২২ মে.টন গমসহ ১২লাখ ৩১ হাজার ৯০ টাকা। কাবিটা-১টি প্রকল্পে ৩ লাখ ২২ হাজার টাকা। অষ্টমিরচর ইউনিয়নে টিআর-১০ টি প্রকল্পে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮ হাজার ৪৪৬ টাকা। কাবিখা প্রকল্পে ১০.৫০১ মে.টন গমসহ ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩০ টাকা। কাবিটা-৬টি প্রকল্পে ২ কোটি ৪০ লাখ ৬ হাজার ৩২০ টাকা। নয়ারহাট ইউনিয়নে টিআর-৪টি প্রকল্পে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮২০ টাকা। কাবিখা প্রকল্পে ০৮.০৫২ মে.টন গমসহ ২ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬০ টাকা। কাবিটা- ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩০ টাকা। রমনা ইউনিয়নে টিআর-১১টি প্রকল্পে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৬ হাজার ৬৯৮ টাকা। কাবিখা প্রকল্পে ৩৯.১৯৬ মে.টন গমসহ ৩ লাখ ২২ হাজার ৬৩০ টাকা। চিলমারী সদর ইউনিয়নে টিআর-৯টি প্রকল্পে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৪ হাজার ২৬০ টাকা। কাবিখা প্রকল্পে ৩২.০৪৫ মে.টন গমসহ ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭২০ টাকা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ কোহিনুর রহমান বলেন, কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্প কমিটিকে চেকের মাধ্যমে টাকা প্রদান করা হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মোঃ শামসুজ্জোহা জানান, এই উপজেলার বালু মাটি হওয়া রাস্তা সংস্কারের স্থায়িত্ব কম। এরপর বন্যায় প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাবি করেন। তবে অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থ নেয়ার আশ্বাস দেন।
×