ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আবদুল কালাম স্মৃতি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার গ্রহণকালে শেখ হাসিনা

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দেশবাসীর প্রতি তার পাওয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কারটি উৎসর্গ করে বলেছেন, ক্ষমতা ভোগ করার জন্য নয়, মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়েই আমি কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষের কল্যাণ করাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোন কিছু চাওয়ার পাওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে কখনো কাজ করিনি। কাজ করেছি দেশের মানুষের জন্য, এখনও সে কাজ করে যাচ্ছি। আমার কাছে সেটাই হচ্ছে বড় পাওয়া। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। সোমবার বিকেলে ড. আবদুল কালাম স্মৃতি আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠত্ব পুরস্কার-২০১৯ গ্রহণ শেষে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী পারস্পরিক আস্থা, প্রত্যয় ও শুভকামনার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গত এক দশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। আমি মনে করি বিশ্ববাসীর কাছে এটাও একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেও আমরা সক্ষম হয়েছি। জনগণের প্রতি কর্তব্য পালনই আমার জীবনের মূলমন্ত্র, যেমনটি ছিল আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আমি এই পুরস্কার দেশের জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করছি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় অসামান্য অবদান, জনকল্যাণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি-সহযোগিতায় বিশেষ অবদান রাখায় ‘ড. কালাম স্মৃতিপদক-২০১৯’ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার হাতে এ পদক তুলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে পদক তুলে দেন ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান উপদেষ্টা ড. টি পি শ্রী নিবাসন ও সংস্থাটির চেয়ারপার্সন দীনা দাস। ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ভারতরতœ ড. এ পি জে আব্দুল কালামের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০১৫ সাল থেকে চালু হয় ‘ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স এ্যাওয়ার্ড’। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বৃদ্ধিজীবীসহ ভারত ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিদেশী কূটনীতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমস্যা থাকবেই। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে একটা সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকলে সে সমস্ত দেশে উন্নয়ন করা অনেক সহজ হয়। সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার পাশাপাশি সেই সমস্ত বিষয়ে আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে পারি। কারন আমাদের সব সময় চিন্তা করতে হবে জনগণের কথা। শুধু আমাদের দেশের জনগণ না, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণও যাতে সুফলটা পেতে পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কিন্তু আমরা আমাদের পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা এক কোটির ওপর মানুষকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিল। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের পাশে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ গড়ায়ও ভারতের বিরাট অবদান রয়েছে। কাজেই সেটা আমরা সব সময় শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অস্ত্রহাতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশের সেই বিজয়ে আমাদের সঙ্গে ছিল ভারত ও ভারতের জনগণ। ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল সব সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি যখন আমরা স্থল সীমানা চুক্তি করি তখন। ভারতের পার্লামেন্টে দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোট দিয়ে কিন্তু সেই বিলটা পাস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের উন্নয়নে নেয়া সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে একটা সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা সুন্দর জীবন পেতে পারে। সেভাবে আমরা আমাদের কাজগুলো করে যাচ্ছি। আমাদের উন্নতির ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে বারবার অনেক আঘাত এসেছে। আমরা নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে চলতে পারিনি। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছিল জাতির পিতাকে হত্যাকা-ের মাধ্যমে, এটা বারবার আঘাত করেছে বাংলাদেশকে। সেই আঘাতের ফলে অর্থনৈতিক উন্নতিটাও বারবার পিছিয়ে গেছে। দেশের জনগণকে আন্তর্জাতিক এ সম্মাননাটি উৎসর্গ করে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাটি উদ্দেশ্য করে বলেন, এই পুরস্কার আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষকে সম্মানিত করেছেন। আমি মনে করি জনগণই হচ্ছে মূল শক্তি। সেই জনগণের প্রতি আমার সকল প্রাপ্ত পুরস্কারকে উৎসর্গ করেই আমি এই পুরস্কার গ্রহণ করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই পুরস্কার আমাকে এবং আমার সরকারকে আগামী দিনগুলোতে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের সংরক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে জনগণের বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জনে কাজ করতে উৎসাহ জোগাবে। কারণ দেশের মানুষের কল্যাণ করতে পারাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, আমার কাছে সেটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। প্রয়াত ভারতের রাষ্ট্রপতি ও পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এ পি জে আবদুল কালাম আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড. এ পি জে আবদুল কালামের আদর্শ ও শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে প্রবর্তিত ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং সম্মানিত বোধ করছি। তিনি (এ পি জে আবদুল কালাম) ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী একজন বিজ্ঞানী এবং ভারতের স্বনামধন্য রাষ্ট্রপতি, যাকে আমি সব সময়ই সম্মান এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখি। আমি তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার ইচ্ছা ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। আর এ জন্য তিনি সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। এ দেশের মানুষের কথা মনে করেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তার কথায় এ দেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জাতির পিতা এ দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। আমাদের চেয়েও (সন্তানদের) তিনি দেশের মানুষকেই বেশি ভালবেসেছেন। দেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২৯তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০১৯ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক এক শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধিটাকে ১০ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই। দেশের দারিদ্র্য এখন ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্যের হার আরও কমিয়ে আনব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এ জন্য আজ আমি তাদের জন্য কাজ করতে পারছি। খাদ্যের পর মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জনগণের জন্য আরও বেশি কাজ করার ক্ষেত্রে এই পুরস্কার আমাকে অনুপ্রাণিত করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ড. কালাম পদক প্রদান উপলক্ষে মানপত্র পাঠ করেন ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপার্সন দীনা দাস। মানপত্রে দীনা দাস বলেন, মর্ডান বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট শেখ হাসিনা যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে, দ্রুত বাংলাদেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাকে (শেখ হাসিনা) প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, ভারতরতœ ড. এপিজে আবদুল কালামের নামে ড. কালাম স্মৃতি আন্তর্জাতিক এক্সিলেন্স পদক প্রদান করা হয়েছে। মানপত্রে তিনি আরও বলেন, ভাতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ড. আবদুল কালাম এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অশিক্ষামুক্ত করে সমৃদ্ধি আনতে কাজ করেছেন। মানপত্রে বলা হয়, সন্ত্রাস, সংঘাত মুক্ত শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া ড. কালাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয়ের ভিশন। এতে আরও বলা হয়, মানব কল্যাণে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাজের স্বীকৃতি এই পদক। যা প্রয়াত ড. আবদুল কালামের স্বপ্ন ছিল। যিনি বলেছিলেন, যা ঘুমিয়ে দেখা হয় তা স্বপ্ন নয়। বরং যা ঘুমোতে দেয় না তাই স্বপ্ন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল থেকে কেরালার ঐতিহ্যবাহী শাড়ি উপহার হিসেবে দেয়া হয়।
×