ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ॥ ২৯ মে ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৯ মে ২০১৯

মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ॥ ২৯ মে ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৯ মে দিনটি ছিল শনিবার। বাংলার সংগ্রামী জনতা যুদ্ধ করছে। এই দিন সুবেদার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার উত্তরে রঘুরামপুরে পাকবাহিনীর একটি টহল দলকে এ্যামবুশ করে। প্রচ- যুদ্ধের পর পাক পেট্রোল-পার্টির একজন অফিসার ও ২৫ জন সৈন্যের সবাই নিহত হয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানির সৈন্যরা কুমিল্লার শালদা নদীর পশ্চিম শিবপুর, বাজরা ও সাগরতলায় পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযানে পাকবাহিনীর ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর দুররানী নিহত ও ২৭ জন সৈন্য হতাহত হয় এবং অনেক প্রতিরক্ষা বাঙ্কার ধ্বংস হয়। ২৮ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসে এবং এইদিন বরগুনা জেলখানায় প্রহসনমূলক বিচারের ব্যবস্থা করে গণহত্যা শুরু করে। জেলখানার উত্তর-পশ্চিম পাশে বরগুনা জেলা স্কুল অবস্থিত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ছাত্ররা স্কুলে এসেছিল। ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচ- গুলির শব্দে শহরময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। বরগুনা জেলখানায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তখন একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রথম দিন তারা ৫৫ জনকে হত্যা করেছিল। অনেকে সেদিন গুলি খেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। কিন্তু তাদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরের দিন আবারও ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বরগুনা জেলখানায় আটককৃত নিরীহ বাঙালীদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যার পর শহরের পৌর এলাকার শহীদ স্মৃতি সড়কের পাশে মুক্তিকামী মানুষদের মাটি চাপা দেয়া হয়। বর্তমান খানজাহান আলী মেট্রো থানার অন্তর্গত মিরেরডাঙ্গা আর আর এফ কোয়ার্টার ও বর্তমান খুলনা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারটিতে নসুখানের ইটেরভাঁটি ছিল। এখানে পাকিস্তানী সেনাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত হত্যাকা- সংঘটিত হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক গণহত্যা সংঘটিত হয় একাত্তরের এই দিন। এই দিন ভারত সীমান্ত পাড়ি দিতে জড়ো হওয়া শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি টহল দল কুমিল্লার বটপাড়ায় পাকসেনাদের দুটি গাড়ির ওপর এ্যামবুশ করে। এতে গাড়ি দুটি ধ্বংস হয় এবং ৪ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সিঙ্গারবিল এলাকায় পাকসেনাদের ওপর এ্যামবুশ করে। এ আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কে করতোয়া নদীর ব্রিজ ভেঙে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নজরুল ও সুবেদার কাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে এবং পাকিস্তানী অগ্রবর্তী বাহিনীকে অমরখানায় আটকে দিয়ে তেঁতুলিয়া থানা মুক্ত রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বরিশালের গৌড়নদী থানার বাটরা বাজারে হেমায়েত বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রাজপুরে এর সদর দফতর স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার করার আগে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমাদের কোন আলোচনা হতে পারে না। একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়েই উভয় সরকারের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, অন্য কোন বিষয়ে নয়। বাংলার সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয় প্রার্থী শরণার্থীর সংখ্যা সরকারী হিসাবে দাঁড়ায় ৩৬ লাখ ৮৮ হাজার ৩ শত ৫০ জন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নয়াদিল্লীতে বলেন, অসংখ্য বাঙালী যখন দেশত্যাগ করে ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে তখন পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে তাদের ঘরোয়া বিষয় হিসেবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর করতে চাইছেন। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বাঙালিদের সাহায্য দানের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। বিশ্ববাসী কি নিরস্ত্র, নিরপরাধী শিশু ও মহিলাদের হত্যা করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অনুমতি দেবেন? নিশ্চয় কখনো তা হতে পারে না। পাকিস্তান সরকারের জনৈক মুখপাত্র রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, দেশত্যাগী প্রকৃত পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বদেশে ফিরে এলে তাদের স্বাগত জানানো হবে এবং পুনর্বাসন করা হবে। ঢাকায় সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পুনর্বিন্যাস-কল্পে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহর আলী, এ.এফ.এম. আবদুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আবদুল বারি, ড. মকবুল হোসেন, ড. সাইফউদ্দিন জোয়ারদার ও জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর পরিচালক ড. হাসানুজ্জামান। এদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড. এ ভুট্টো দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত জনগণের সমস্যাবলী সমাধান হতে পারে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বেআইনী ঘেষিত হবার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব আমাদের উপরিই অর্পিত হয়েছে। সমস্যার সমাধান আমাদেরকেই করতে হবে।’ দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধীরা শান্তি কমিটি গঠন করে। কমিটিগুলো হচ্ছেÑ নোয়াখালী সদর- গোলাম মোস্তফা, ফেনী মহকুমা-খাজা আহমদ, চাঁদপুর মহকুমা-এম.এ আলম, হাজিগঞ্জ থানা- আনোয়ার হোসেন, মতলব থানা-ড.আব্দুল হক ও কচুয়া থানা-আব্দুল মজিদ। এইদিন ইউএনআই এর বরাতে দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘ঢাকায় আরো তীব্র হচ্ছে গেরিলা হামলা ১৫০ পাকসেনা নিহত’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সপ্তাহের শুরুর দিকে রংপুর সেক্টরের ধরলা নদীর পারে পাকিস্তানী এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যবর্তী প্রবল এক সংঘর্ষে অন্তত ১৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পিটিআই। পাকিস্তানী আর্মি নদী পার হবার চেষ্টা করলে তা বানচাল করতে মুক্তিবাহিনী হামলা চালায় এবং তা প্রতিপক্ষের গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। এদিকে ২৬ মে, সিলেট সেক্টরে মুক্তিবাহিনী একটি পাকিস্তানী কনভয়ে হামলা চালালে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং আরো ১৪ জন আহত হয়। একটি ট্রাক ও একটি জীপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিবাহিনী একইসাথে এই সেক্টরের রেমা চা বাগানে হামলা চালালে পাকিস্তানী বাহিনী তড়িঘড়ি করে সেখান তাদের দুইটি যুদ্ধযান রেখে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী তা দখল করে নেয়। মে এর ২৩ তারিখে, মুক্তি বাহিনীর একজন ছাত্রযোদ্ধা চট্টগ্রাম এলাকায় গ্রেনেড হামলা চালালে দুইজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। একই রাতে মুক্তিবাহিনী ছাগলনাইয়া অঞ্চলের নিকটবর্তী মুহুরি নদীতে অবস্থিত একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ময়মনসিংহের ভটিখালিতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনা ফাঁড়িতে হামলা চালায়, সিলেটে জয়নায়াপুরে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। কুমিল্লা সেক্টরের বাজিতপুর পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সেখানে মজুত সকল গোলাবারুদ লুট করে নেয়। রংপুরের পাটেশ্বরী ঘাটেও পাকিস্তানী সেনা এবং মুক্তিবাহিনীর মাঝে প্রবল সংঘর্ষ হয়, যদিও কোন হতাহতের খবর জানা যায়নি। আমাদের শিলং অফিস আরো জানায় যে, পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে সামান্য সংঘর্ষের পর ডাউকি-সিলেট রোডে অবস্থিত সর্ববৃহৎ সারি ব্রিজটি বীর মুক্তিযোদ্ধারা গতকাল উড়িয়ে দিয়েছে। সিলেটের মূল ভ-ূখণ্ড থেকে পাকিস্তানী বাহিনী এখন সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×