১৯৭১ সালের ২০ মে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অমানবিক বর্বরতার খবর প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি বিশ্বের অনেক দেশের জনগণ সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং সমর্থন জানায়। পাকিস্তানীরা একে একে গুলি করে মানুষ হত্যা করে। গণহত্যার পাশাপাশি বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী নারীদের ধর্ষণ করে। জাতির গৌরবময় এ অধ্যায়ের প্রতিটি পাতায় জড়িয়ে আছে আত্মাহুতি আর নৃশংসতার করুণ ইতিহাস। এই দিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান, ইউএনআই-এর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেন, আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে নই, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। আমাদের স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার আইনগত অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম নয়। আমরা ইসলামসহ সকল ধর্মের মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করব। আমরা শোষণমুক্ত, সুষম ও শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানুষের মাঝে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। যারা বাংলাদেশকে নিজেদের মাতৃভূমি হিসেবে স্বীকার করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তারা যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন তারা আমাদের ভাই। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দখলদার বাহিনীর সহযোগিতা করেছে, তারা যে ধর্মের হোক, আমাদের শত্রু বাংলাদেশের শত্রু। এই দিন পাক বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য কুশিয়ারা অতিক্রম করে সিলেটের সুতারকান্দি ও বড়গ্রাম আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পাল্টা আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধ ‘সুতারকান্দি যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে ৩৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে, দু’জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। কুষ্টিয়ার বল্লভপুর মিশনারী গির্জা লুট করে ঘাঁটিতে ফেরার সময় পাকসেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে ২৭ জন পাকসেনা নিহত ও ৫-৬জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনী এ অভিযানে একটি জিপ ও কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে। সিলেটের নালুয়া চা বাগানে পাক বর্বররা ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এতে ২০ জন নিরীহ চা শ্রমিক নিহত হয়। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি নদীর পারে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। নদীতে লাশ আর রক্তের স্রোত। যে স্রোতে ভেসে ছিল অগণিত লাশ। রক্তে চারদিক লাল হয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ অনেকেই তখনও বেঁচে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ভোর হওয়াই যেন কাল হলো জীবন বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে বেড়ানো হাজারো নিষ্পাপ মানুষের। খুলনার চুকনগরে ২০ মে পাক হায়েনাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হলেন এসব মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্য যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, এর মধ্যে চুকনগর গণহত্যা অন্যতম। ১৯৭১ সালের এই দিনে খুলনার ডুমুরিয়ার ছোট্ট শহর চুকনগরে পাকিস্তানী বর্বর সেনারা নির্মম এ হত্যাকা- ঘটায়। অতর্কিত হামলা চালিয়ে মুক্তিকামী ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ দিন যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ হলেও বহু নারী ও শিশুকেও হত্যা করে পাকিস্তানী সেনারা। শিশু মায়ের বুকের দুধপান করছিল- এমন অবস্থায় চলে ঘাতকের কামান। ঘাতকের বুলেট মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে মা, কিন্তু অবুঝ শিশু তখনও অবলীলায় মায়ের স্তন মুখের মধ্যে রেখে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, গোপালগঞ্জ থেকে হাজার হাজার বাঙালী নৌপথে ও হেঁটে আসতে থাকে চুকনগরে। এ আসা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে অনেক বাঙালী সীমান্তের ওপার ভারতে চলে গেছেন। চুকনগরে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাঙালীরা অপেক্ষা করতে থাকে ভারতে পাড়ি দেওয়ার জন্য। প্রতিদিনের মতো আগের দিন চুকনগরে আসা বাঙালীরা আশ্রয় গ্রহণ করে ওই এলাকার স্কুল ঘরে, বাজারে, পার্শ্ববর্তী পাতোখোলা বিলের ধারসহ বিভিন্ন স্থানে। এই পলায়ন শুধু জীবন বাঁচানোর জন্যই নয়, অনেকের লক্ষ্য ছিল স্বদেশ ভূমিকে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া। ২০ মে সকালে প্রত্যেকেই ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে সকাল ১০টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই/তিনটি গাড়ি এসে থামে পোতোখোলা বিলের পাশে। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালীদের সহায়তায় পাকিস্তানী বাহিনী শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সম্ভবত এক প্লাটুন। ট্রাক থেকে নেমে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি কর্মমুখর ও ব্যস্ত এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। গণহত্যার পাশাপাশি বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী যুবতী নারীদের ধর্ষণ করে। এছাড়াও অনেক বাঙালীকে নিকটবর্তী পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে পরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। আবার যারা আহত হয়েছিল তাদের বর্বর পাকিস্তানী বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ভদ্রা নদীতে লাশ ফেলার দায়িত্ব দেওয়া হয় অনেককে। প্রতি লাশের জন্য ৫০ পয়সা দেওয়া হবে বলে ঘোষণাও করা হয়। লাশের গায়ের স্বর্ণালঙ্কার ও সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ ওই ৫০ পয়সার গুরুত্ব ম্লান করে দেয়। ‘ডেইলি টেলিগ্রাফের’ প্রতিনিধি একাত্তরের এই দিনে রিপোর্ট করেন যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানী আর্মি দাবি করে সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিন্তু তারা এখন আশঙ্কা প্রকাশ করছে বাংলাদেশে ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতি রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে অন্তত ৩০ রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। পাকিস্তানের উর্ধতন কর্মকর্তারা অনুমান করছে আরও নিবিড় গেরিলা যুদ্ধ সামনের বর্ষাকালে উপস্থিত হবে। মুক্তিযোদ্ধারা সকল সেক্টরে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুদের ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে তারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করছে, মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং পথঘাট বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তানীদের কৌশলগতভাবে ভোগান্তি দিয়ে যাচ্ছে। সব সেক্টরেই পাকিস্তানী বাহিনী চলাচলের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। পাকিস্তানী বাহিনীর চলাচল বন্ধ করতে মুক্তিসেনারা বিরল এবং কাঞ্চন সংযোগকারী ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের রংপুর প্রতিনিধি জানায়, লালমনিরহাট এবং বড়বাড়ির মাঝামাঝিতে টহলরত অবস্থায় পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এই অপারেশনে ১৬ জন শত্রু নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা স্বরমাটি রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানী সেনাদের বহনকারী ট্রেনে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে এবং তাদের দশ জনকে হত্যা করে। তিস্তার ভটমারি ঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা দু’টি ফেরি বোট ডুবিয়ে দেয়। এই ফেরি দু’টি পাকিস্তানীরা তাদের সৈন্যদের চলাচলের কাজে ব্যবহার করত। উত্তরের সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানী হানাদার সৈনিকদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত শুক্রবার ভূরুঙ্গামারিতে পাকিস্তানী সেনাদের ভারি গোলাগুলি বিনিময় করে এবং শত্রুদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ ঘটায়। এখানে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। দিনাজপুরে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈনিকদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। রেডিও অস্ট্রেলিয়া রিপোর্ট করে, কলকাতার রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশে গত দুই মাসে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তিনজন যাজক নিহত হয়েছেন। আর্চবিশপ বলেছেন শেষ হত্যাকা-টি সংগঠিত হয় ৮ মে, চার্চ বন্ধ করে যাজক বের হলেই তার গায়ে পাকিস্তানীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। জাতি সংঘের বিভিন্ন সহায়ক সংস্থা পশ্চিম পাকিস্তানের সৈনিকদের নৃশংস গণহত্যায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে, লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ দ্য ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের ২৩ম সাধারণ সভায় বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। ভেনেজুয়েলার আইন সভার সদস্যরা জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকারের দিকে দৃষ্টি দিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে বলেন। যে সীমাহীন অন্যায় অত্যাচার বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে বিশেষ করে গণহত্যার মতো ঘৃণ্য কর্মকান্ডের জন্য ভেনেজুয়েলার আইন সভার দু’শ ১৪ জন সদস্য একমত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালায় তার প্রতিবাদস্বরূপ থাইল্যান্ড পাকিস্তান বিমানের জ্বালানির যোগান বন্ধ করে দেয়। ভ্যাটিকানের দৈনিক ‘অবজারভেটরি রোমানো’ প্রকাশ করে যে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে যে যুদ্ধের ভিতর টেনে এনেছে তা একটি অসম যুদ্ধ। প্রথম পাতার মন্তব্যে পত্রিকাটি বলে, এই সঙ্কট সমাধানের জন্য পাকিস্তানের উচিত এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করা। এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাকে মেনে নেওয়া। অন্যথায় গেরিলা যুদ্ধের কারণে পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে যেটা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আঘাত হানবে। পাকিস্তান সরকার অনেক পরে দাতা দেশগুলোর কাছে স্বীকার করেছে বাংলাদেশের জনগণ বঞ্চনার স্বীকার হয়েছে; যার ফলেই এই যুদ্ধ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]