ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিডরে বড় ছেলে ফণীতে মা ও ছোট ছেলে হারাল ইব্রাহীম

প্রকাশিত: ১০:২৫, ৬ মে ২০১৯

 সিডরে বড় ছেলে ফণীতে মা ও  ছোট ছেলে  হারাল ইব্রাহীম

সংবাদদাতা, পাথরঘাটা, বরগুনা, ৫ মে ॥ সিডরে বড় ছেলে, ফণীতে মা ও ছোট ছেলে মাটিচাপা পড়ল বরগুনার পাথরঘাটার জেলেপল্লীর হতভাগা ইব্রাহীমের। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন ইব্রাহীম। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে ছেলে আর মায়ের মৃতদেহ দেখতে হবে ঘুণাক্ষরেও ভাবতেও পারেননি ইব্রাহীম। প্রতিবেশী, আপনজন, এলাকাবাসী রাজনৈতিক নেতাসহ প্রশাসনের সান্ত¦নায় কি এমন শোক ভোলা সম্ভব? মৃত্যু এমনই নিষ্ঠুর হয়! কান্নাভেজা কণ্ঠে ইব্রাহীম বিলাপ করছেন আর বলছেন, ‘মোর পোলা দুইডারে নেলো, লগে মায়ও গেলো!’ থেমে থেমে বলছিলেন, ‘অগো রেডি রাখছিলাম পরিস্থিতি খারাপ অইলেই আশ্রয় কেন্দ্রে যামু। খালে পানি বাড়ছে কিনা দ্যাখতে বাইর অইছি, এ্যার মইদ্দে আচুক্কা বাতাস ছাড়ছে। আইয়া দেহি ঘর চাপা পর্ইরা মোর মায় আর ছোডো পোলাডা শ্যাষ’। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের দরিদ্র জেলে ইব্রাহীমের ৩৫ বছরের জীবনের বাস্তব গল্প এটি। অন্যের ট্রলারে মাছ ধরে শ্রমিকের জীবন ইব্রাহীমের। বিষখালী আর বলেশ্বর যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিলেমিশে একাকার ঠিক সেখানে মাছ ধরে চলে ইব্রাহীমের সংসার। স্ত্রী সন্তান আর পিতা-মাতাকে নিয়ে এক রকম ভালই কাটছিল ইব্রাহীমের পরিবার। ২০০৭ সালে সিডর যখন উপকূলে আঘাত হানে তখনও জীবিকার তাগিদে মাছ ধরা ট্রলারেই ছিল ইব্রাহীম। মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ঝড়ো হাওয়ায় উল্টে যায় তার ট্রলারটি। অথৈ সাগরে ভাসতে থাকে ইব্রাহীম। এদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাওয়ার সময় জলোচ্ছ্বাসের প্রবল চাপে স্ত্রী জেসমিনের কোল থেকে ছিটকে পড়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় বড় ছেলে রবিউলের। চোখের সামনে নিজের কোল থেকে ছিটকে পড়ে হারিয়ে যাওয়া একমাত্র ছেলের স্মৃতিতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে মা জেসমিন। ২০১০ সালে জেসমিনের কোলে জন্ম নেয় ছেলে জাহিদুল। এরপর বড় ছেলে হারানোর শোক আর অভাব-অনটনে সংসারের বোঝা বইতে না পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন স্ত্রী জেসমিন। ছোট ছেলে জাহিদুল (৮) আর মেয়ে জান্নাতিকে (১০) নিয়ে এক রকম চলছিল ইব্রাহীমের সংসার। এর মধ্যে রোগে শোকে ভুগে একাধিকবার স্ট্রোক করে মৃত্যু হয় বাবা আঃ বারেকের। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাত ৩টার দিকে আরেক ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে কাঠের ঘরের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় মা নূরজাহান বেগম এবং ছোট ছেলে জাহিদুলের। স্থানীয় লোকজন জানান, স্ত্রী জেসমিনের আত্মহত্যার দুই বছর পর বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তার ছোট ছেলে রবিউল থাকত মঠবাড়িয়ায় তার বড় বোন রাহিলার বাড়িতে। গত শুক্রবার সকালে বড় বোন রাহিলা তার ছোট ছেলে জাহিদুলকে বেড়াতে নিয়ে আসে। জাহিদুলকে বাড়িতে রেখে ছোট মেয়ে জান্নাতিকে নিয়ে মঠবাড়িয়ায় ফিরে যায় সে। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে একবার আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চাইলে মা নূরজাহান যেতে রাজি না হওয়ায় সবাই থেকে যান বাড়িতে। রাত ২টার দিকে প্রচ- ঝড়ের মধ্যে হঠাৎই তাদের ঘর ভেঙ্গে পড়লে ঘরের নিচে চাপা পড়ে মারা যান মা নূরজাহান আর জাহিদুল। তিনি আরও বলেন, সিপিপি টিম লিডার মোহাম্মদ শহীদুলল্লাহ তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে বারবার যেতে বললেও তার কথা না শোনায় এ ঘটনা ঘটে। শনিবার সকালে পাথরঘাটা উপজেলায় দুর্যোগকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত বরগুনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেন ইব্রাহীমের বাড়ি পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকার সহযোগিতা দেন ইব্রাহীমকে। তিনি জানান, ইব্রাহীমের জীবন বড়ই দুঃখময়। ইব্রাহীম যাতে সরকারী-বেসরকারীভাবে আরও সহযোগিতা পান সে বিষয়ে ব্যবস্থা করা হবে।
×