ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘোষণা গণপূর্তমন্ত্রীর

আগামী এক বছরের মধ্যেই বাসযোগ্য হবে পূর্বাচল সিটি

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২ মার্চ ২০১৯

আগামী এক বছরের মধ্যেই  বাসযোগ্য হবে  পূর্বাচল সিটি

মশিউর রহমান খান ॥ আগামী এক বছরের মধ্যেই রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নতুন শহর পূর্বাচল প্রকল্প সম্পূর্ণ বসবাসের উপযোগী করার ঘোষণা দিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম অতি দ্রুততার সঙ্গে মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশও দেন তিনি। বসবাস উপযোগী করতে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ও তা সঠিকভাবে মান রক্ষা করে নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তাও নিয়মিত মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নেন গণপূর্তমন্ত্রী। ঘোষিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যে কোন মূল্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে একান্ত সাক্ষাতকারে গণপূর্তমন্ত্রী জনকণ্ঠকে জানান। প্রকল্পের মেয়াদ ’২০ সালের জুন পর্যন্ত থাকলেও ইতোমধ্যেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শহরটিকে বসবাসের উপযোগী করতে নতুন মন্ত্রী শপথ গ্রহণের পর পরই প্রকল্পের কাজের গতি বৃদ্ধিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে রাজউক ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। একই সঙ্গে মন্ত্রীও মেয়াদের আগেই ঘোষিত সময়ের মধ্যেই যেন প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। এর পর পরই নড়েচড়ে বসেছে রাজউক ও পূর্বাচল প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ঠিকাদাররা। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী এক বছরের মধ্যেই পূর্বাচলের কমপক্ষে ৮০ ভাগ জায়গা বসবাসের, ব্যবহারোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। যেসব স্থান বা প্লট গ্রহীতারা এখনও বুঝে নেননি সেসব প্লট বুঝে নেয়ার পর পরবর্তীতে ওসব জমিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে বলে জানা গেছে। নতুন শহর পূর্বাচল প্রকল্প সম্পর্কে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, বরাদ্দ বুঝে পেয়েছেন এমন সব প্লট গ্রহীতা যাতে পূর্বাচলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন এ জন্য রাস্তাঘাট, মসজিদ, বিদ্যুত, পানিসহ সকল প্রকার ইউটিলিটি সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা প্রদান করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে রাজউককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নতুন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকদের বিশেষ চাহিদার প্রেক্ষিতে সরকারের মেগা ও অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে পূর্বাচলকে বসবাসের জন্য নির্ধারিত সময়েই উপযোগী করতে রাজউককে সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি। তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যেই পূর্বাচলে সরেজমিন পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাস্তবে সকল কাজ পরিদর্শন করে কিভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই করতে পরিদর্শনে যাব। গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, অতিগুরুত্বের সঙ্গে পূর্বাচল প্রকল্পটি ঘোষিত সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে চাই। এরই অংশ হিসেবে রাজউকের কাছে প্রকল্পের কাজ সম্পর্কে নিয়মিত মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে প্রতিটি কাজের খাতওয়ারি প্রতিবেদন চাওয়া হবে। প্রকল্প পরিচালকের কাছে এসব তথ্য চাওয়ার সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যেই সর্বশেষ তথ্যসহ তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। এই তথ্য প্রাপ্তির পরই কোন্ কোন্ সমস্যার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা নিরূপণ করে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া প্রকল্পের কাজ মানসম্পন্নভাবে করা হচ্ছে কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, মূলত আমরা চাই বর্তমান সরকারের এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বছরের পর বছর একইভাবে পরিচালিত হতে পারে না। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা সমস্যা থাকতেই পারে। তবে এর জন্য সমাধানও রয়েছে। প্লট গ্রহীতারা যাতে পূর্বাচলকে নিয়ে কোন প্রকার নিরুৎসাহিত না হয় সে লক্ষ্যেই সরকার আগামী এক বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ বসবাসের উপযোগী করে তোলা হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পূর্বাচল প্রকল্পের কাজ মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতি সপ্তাহেই কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন চাইবে। এর মধ্যে প্রকল্প এলাকার রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণের অগ্রগতি, বিদ্যুতায়ন কাজের অগ্রগতি, পানি সরবরাহ কাজের অবস্থার অগ্রগতি, পূর্বাচলের বিশেষ লেকের কাজের সর্বশেষ তথ্য ও অগ্রগতি, লেকের পাশ ঘিরে নাগরিকদের হাঁটার জন্য তৈরি বিশেষ ওয়াকওয়ের অগ্রগতি, পূর্বাচলের বিশেষ উদ্যোগে গ্রীন জোন বা সবুজায়ন কাজের অগ্রগতি, ইকোপার্ক নির্মাণের অগ্রগতি, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ ও সর্বশেষ অবস্থার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে চাওয়া হবে। পূর্বাচল প্রকল্প ও এলাকাসূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারগণের অবহেলার কারণে প্রকল্পটি বাস্তাবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারগণ প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। এর ফলে সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পটি বছরের পর বছর ধরে নির্ধারিত সময় পার হলেও বাস্তবায়নের হার অত্যন্ত কম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃষ্টি ও বর্ষার অজুহাতে ঠিকাদারগণ বছরের শুকনো মৌসুমেই কেবলমাত্র কয়েকমাস কাজ করে। বাকি ৮-৯ মাস প্রকল্পে তেমন কোন কাজই করেন না ঠিকাদারগণ। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নেও তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে ঠিকাদারদের নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেয়া হলেও পূর্বাচল প্রকল্পের কাজ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে প্রকল্পের মেয়াদ যেমন একদিকে বাড়ছে তেমনি বাড়ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয়। অপরদিকে প্লট গ্রহীতারাও রয়েছেন মহাবিপাকে। প্রকল্প সূত্র জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি মোট ৬ হাজার ২শ’ ২৭ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ না হওয়ায় এর মেয়াদ ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় বর্ধিত করে সরকার। এখন পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। প্রকল্পটিতে বিভিন্ন শ্রেণী ও আয়তনের মোট ২৫ হাজার ১৬ টি আবাসিক প্লট রয়েছে। আবাসিকের বাইরে বিভিন্ন আয়তনের বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া, পার্ক, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিশ্ববিদ্যালয়, আরবান ফ্যাসিলিটি, এপার্টমেন্ট ব্লকের জন্য মোট ৩ হাজার ৫ শ’ ৬৫ টি প্লট রয়েছে। প্রকল্পটিতে ৩শ’ ১৯ কিলোমিটার রাস্তা, ৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার একটি ফ্লাইওভার, পূর্বাচল লিংক রোড ১৩ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার, ৪৩ কিলোমিটার লম্বা বিশাল লেক, ৬৫ টি বিভিন্ন আকারের ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করা হবে। এছাড়া লেকের পাশে নাগরিকদের হাঁটার জন্য বিশেষ ওয়াকওয়ে তৈরি, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি, প্রকল্পে বিশেষায়িত গ্রীন জোন তৈরি, পুরো এলাকা সবুজায়ন করা ও ইকোপার্ক নির্মাণসহ নাগরিকদের বসবাসের জন্য একটি নতুন মডেল শহর হিসেবে তৈরি করা হবে পূর্বাচলকে। ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে প্রকল্পটি শেষ করার কথা থাকলেও নানা সংযোজনের পর পরবর্তীতে ২০০৫ সালে মূল পিপিপি প্রণয়ন করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, স্থানীয় জমির মালিকদের কর্তৃক মামলা দায়ের, পুনরায় আরডিপিপি প্রণয়ন, অর্থ ব্যয় বৃদ্ধি, সংশোধন, প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে নানা বিষয় সংযোজন, প্রকল্পের নক্সা সংশোধন, কুড়িল ফ্লাইওভার ও লিংক রোড সংযোজন, টেলিফোন, বিদ্যুত, পানি তথা ইউটিলিটি সার্ভিস সংযোজনসহ সময়মতো প্রকল্প কাজ শেষ না করার কারণে কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি করে সরকার। সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রকল্পে ভৌত অবকাঠামোগত শতকরা মোট ৫৯ ভাগ কাজ অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের নির্মাণাধীন অবকাঠামোর সঙ্গে সর্বশেষ প্রণীত ড্যাপ, সরকারী পরিকল্পনা ও সম্প্রতি সরকারের অনুমোদিত খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে ড্রয়িং ডিজাইন সংশোধন করতে বিআরটিসি ও বুয়েট কর্তৃক যৌথভাবে কাজ করছে। নির্ধারিত সময়েই প্রকল্পটিতে বসবাসের উপযোগী করা হলে ও সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে রাজধানীর আশপাশের এলাকাটি বিশ্বের কাছে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন বাংলাদেশের এক নতুন শহর হিসেবে পরিচিত করা সম্ভব হবে।
×