ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম আর মাহবুব

একুশের প্রথম বুলেটিন

প্রকাশিত: ১০:০১, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

একুশের প্রথম বুলেটিন

একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী রাতের মধ্যেই একটি বুলেটিন প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশি ব্যারাক এলাকায় বিলি করেন। সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী, হাসান হাফিজুর রহমান, পাটুয়াটুলির সওগাত অফিসের বিপরীত গলিতে অবস্থিত পাইওনিয়ার প্রেসে যান। দুটি টেবিলে বসে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা ছাত্র হত্যার সংবাদের হেডলাইনের সংক্ষেপিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে ফেলেন। তাৎক্ষণিক একটি বুলেটিন তৈরি হয়ে যায়। বড় এক শিট কাগজে যত শীঘ্র সম্ভব রাতের মধ্যে ছেপে ফেলার ব্যবস্থা করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসেন। এ বুলেটিনের ভাষ্যে একটি মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয় ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব।’ ওই মন্তব্যটি লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁর মতে এটাই ছিল একুশের প্রথম বুলেটিন। ভাষা সংগ্রামী আলাউদ্দিন আল আজাদের শেষ সাক্ষাতকারটি আমার নেয়া। ২০০৭ সালের ১৪ জুলাই উত্তরার বাসায় আমি তার সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করি। কয়েকদিন পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে যান এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০৯ সালের ৩ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সাক্ষাতকারে তিনি প্রথম একুশের প্রথম বুলেটিনের কথা বলেন। ওই সাক্ষাতকারটি ‘একুশের প্রথম বুলেটিন ও আলাউদ্দিন আল আজাদ’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয় আলাউদ্দিন আল আজাদের মৃত্যুর পরদিন। ওই সাক্ষাতকারে তিনি আমাকে একুশের প্রথম বুলেটিন নিয়ে বেশ কিছু গুরুতপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন। সাক্ষাতকারের পূর্বেও বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়। আলাউদ্দিন আল আজাদের অনুরোধে ওই বুলেটিনের সন্ধানে আমি আর্কাইভস্-এ অনুসন্ধান চালাই। তার কথামতো অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি প্রথম বুলেটিনের সত্যতা স্বীকার এবং বুলেটিনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার কথা বললেও বুলেটিনের কোন সন্ধান দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত কোথাও এর কোন সন্ধান পাইনি। একুশের প্রথম বুলেটিনের উদ্যোক্তা কবি, সাব্যসাচী লেখক ও ভাষা সংগ্রামী আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন- ‘একুশের প্রথম বুলেটিনটি ডাবল ক্রাউন কাগজে ছাপা হয়, পত্রিকার কাগজের মতো বড় একটা পৃষ্ঠায় কয়েকটি লেখা ছিল। লেখাগুলো তৈরি করেন হাসান হাফিজুর রহমান ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। আরও দু’একজনের ছোট করে কয়েকটা লেখা ছিল, তাদের নাম আজ মনে পড়ছে না। ছাপার সময় আমাদের সঙ্গে ছিল আমীর আলী কিন্তু তার কোন লেখা ছাপা ছিল না। হাসান হাফিজুর রহমান বুলেটিনে লেখা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে যান লিফলেট ছাপা ও বিতরণের জন্য তার উদ্যোগই শফিউদ্দিনের ক্যাপিটাল প্রেস থেকে ছোট সাইজের প্রথম লিফলেটটি ছাপা হয়। আমীর আলীও হাসানের সঙ্গে চলে যায়। বুলেটিন প্রকাশের পূর্বেই লিফলেটটি ছাপা ও বিলি হয়ে যায়। আমি ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই লিফলেট তৈরি ও ছাপার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পাইওনিয়ার প্রেসের মোহাইমেন সাহেব ও তাঁর ছোট ভাই আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। প্রেসের ভেতরে একটি বড় টেবিল দিয়ে এবং কাগজ দিয়ে আমাদের লেখার সুযোগ করে দেন। বুলেটিনটি ছাপার জন্য তাঁরা আমাদের কাছ থেকে কোন টাকা-পয়সা নেননি। বিনা পয়সায় ছাপিয়ে দেন। প্রেসের কম্পোজিটর ও কর্মচারীরা অতিদ্রুত কম্পোজ ও ছাপার কাজ শেষ করেন। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার কারণে রাতের মধ্যেই বুলেটিনটি ছাপানো সম্ভব হয়েছিল। প্রেসের কর্মকর্তা প্রুফ ও কারেকশনের অনুরোধ করলে আমি বলি, এত কারেকশন লাগবে না। তাড়াতাড়ি ছাপান। বুলেটিনটি বড় কাগজের এক পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। আমার একটি দীর্ঘ লেখা ছিল, সেখানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘট, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আইন সভার ভাষণ থেকে শুরু করে একুশের হত্যাকা- সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। আমার এ দীর্ঘ লেখায় একুশের হত্যাকা-ের তীব্র প্রতিবাদ করা হয় এবং নূরুল আমীন সরকারের সমালোচনা করা হয়। বুলেটিনের শিরোনাম ছিল ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব।’ এই শিরোনামটি আমিই নির্বাচন করি। একুশের মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। এই শিরোনামের মধ্য দিয়ে আমি আমার ক্ষুব্ধমনের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলাম। শিরোনামটি তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বুলেটিনটি নূরুল আমীন সরকারের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একবার নূরুল আমীন তাঁর বক্তৃতায় ওই বুলেটিনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। রাত ১২টায় প্রেস থেকে প্রথম ৩০০ কপি নিয়ে আসি। পরবর্তী সময়ে আরও কপি ছাপা হয়। আমি তখন ২য় বর্ষ অনার্সের ছাত্র। বন্ধুদের নিয়ে রাতের মধ্যেই ৩০০ কপি বিলি করি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পলাশি ব্যারাক এলাকায়। তখনও প্রচুর মানুষের আনাগোনা ছিল। পুলিশ ও আর্মির বেষ্টনী সত্ত্বেও যেখানে গুলি হয়েছিল সেখানে ও আশপাশের এলাকায় তখনও প্রচুর লোকজন ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল এলাকায় সারারাত মানুষের আসা-যাওয়া ছিল। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় গায়েবি জানাজা শেষে সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে আবারও বুলেটিনটি বিলি শুরু করি। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার মাঝেও বিলি করা হয়। বুলেটিনের বিষয় নিয়ে কোন কোন পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। একুশের এই প্রথম বুলেটিন নিয়ে ছাত্র-জনতার মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল লক্ষণীয়। (সূত্র : লেখকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে আলাউদ্দিন আল আজাদ, ১৪ জুলাই-২০০৭, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ আষাঢ়, ১৪১৬)। লেখক : নির্বাহী পরিচালক, ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর
×