ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিক ॥ প্যারি চাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিক ॥ প্যারি চাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল

বাঙলা সহিত্যের প্রথম উপন্যাসের পথ প্রদর্শক প্যারি চাঁদ মিত্র ওরফে টেক চাঁদ ঠাকুরের ১৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই কলকাতার এক ধনী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রাম নারায়ণ মিত্র ছিলেন সেকালে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। প্যারি চাঁদের মানষ গঠনে পরিবারের বেশ কিছুটা প্রভাব ছিল। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় তাদের পরিবারের সে সময় যথেষ্ট সুনাম ছিল। তাঁর মাতা আনন্দময়ী দেবী নারী শিক্ষার সেই অন্ধকার যুগেও ছিলেন যথেষ্ট প্রাপ্তা। পারিবারিক শিক্ষা ছাড়াও প্যারী চাঁদ মিত্র শৈশবে একজন গুরু মশাইয়ের কাছে সাংস্কৃতি ও মুন্সীর কাছে ফারসিতে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারী চাঁদ মিত্র হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলেজ শিক্ষা সমাপ্ত করে যখন তিনি বেরিয়ে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তিনি ছিলেন সে সময়ে হিন্দু কলেজের বৃত্তি পাওয়া কৃতী ছাত্র। তাঁর মনস্তত্ত্ব ও নীতি দর্শনে ছিল অসাধারণ জ্ঞান। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ তিনি কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরীতে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এখানেই তাঁর প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়। বাঙালী সমাজে টেক চাঁদ ঠাকুর নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও কোম্পানি প্রেসে ছাপা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস (১৮১ পৃষ্ঠার একটি বাংলা বই) প্যারি চাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। যদিও এই গ্রন্থটি ছাড়াও তিনি ‘মদ খাওয়া বড় দায়’ (১৮৫৯ খ্রি.), ‘জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯ খ্রি.), ‘রামার রঞ্জিকা’ (১৮৬১ খ্রি.), ‘অভেদ’ (১৮৬১ খ্রি.) এবং ‘আধ্যাত্মিকা’ (১৮৮০ খ্রি.) ছাড়াও আরও কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮ খ্রি.) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গিয়েছিল তৎকালীন সাহিত্য পিপাসু মহলে। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বইটির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছিলেন। প্যারী চাঁদ মিত্রই প্রথম সাহিত্যিক যিনি কথ্য ও সাধুভাষার মধ্যে দূরত্ব দূর করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাহিত্যের যোগাযোগ স্থাপন করেন। প্যারী চাঁদ মিত্রের অসাধারণত্ব বিশ্লেষণ করে বঙ্কিম চন্দ্র লিখেছিলেন ‘উহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপর কেহ প্রণিত করিয়া থাকিতে পারিবে কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলাল’ দ্বারা বাংলা সাহিত্যের যে অশেষ কল্যাণ সাধিত হইয়াছে তা আর কোন বাংলা গ্রন্থে সেই রূপ হয় নাই।’ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারী চাঁদ মিত্রের বাল্যবন্ধু রাধানাথ শিকদার (তৎকালীন গণিতের মেধাবী ছাত্র ও এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয়কারী) সম্পাদনায় একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই পত্রিকায় প্যারী চাঁদ ‘টেক চাঁদ ঠাকুর’ এই ছদ্মনামে তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়ে প্রচারিত হয়। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে জানা যায় ‘আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮ খ্রি.)’ হচ্ছে বাঙালী লিখিত প্রথম উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিকের মর্যাদা যদি কাউকে দিতে হয় তা হলে সেই সম্মান প্যারী চাঁদ মিত্রেরই প্রাপ্য। অবশ্য ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে ক্যাথরিন মুলেন্স নামক একজন বিদেশিণী খ্রিস্টানের লেখা ‘ফুলমনি ও করুনার বিবরণ’ (১৮৫২ খ্রি.) একটি উপন্যাসের সন্ধান আমরা পাই। এই গ্রন্থটিতে একটি খ্রিস্টান পরিবারের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছিল। শ্রীমতী মুলেন্স অতি চমৎকার বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তবে উপন্যাস হিসেবে এটাকে স্বার্থক বলা চলে না। তাছাড়া ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ গ্রন্থটি মূলত ঞযব ষধংঃ ফধু ড়ভ ঃযব বিবশ নামক একটি ইংরেজী গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত। তাছাড়া গ্রন্থটির কাহিনী নির্জীব, নীরস। সেই জন্য এটি সে সময় চিত্তকর্ষক হতে পারে নাই। এর তুলনায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটিকেই সেই সময় বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক আদর্শের স্বার্থক উপন্যাস হিসেবে বঙ্কিম চন্দ্রের ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ প্যারী চাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮ খ্রি.)’ এবং কালী প্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাচার নকশা (১৮৬২ খ্রি.)’ কেন্দ্র করেই বাংলা উপন্যাসের বীজ অনুরীত হয়ে উঠেছিল। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে বাবু রাম বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মতিলালের জীবনে ছন্ন ছাড়া নারী সঙ্গ, কামুকতা এবং মদ্যপান ঘটিত বিড়ম্বনা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। অবশ্য সে সময়ের লেখা আরেকটি উপন্যাস ভবানী চরনের ‘নববাবু বিলাস’। এই নব বাবু বিলাসেও তৎকালীন বাঙালী সমাজের চিত্র পিতার অমনোযোগের ফলে পুত্রের পাঠ্যাভাসের হানি হলে তার চরিত্র স্ত্রৈন্যতা এবং পাপা দোষের দ্বারা কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে তা সুন্দরভাবে এই উপন্যাসটিতেও (নববাবু বিলাস) দেখানো হয়েছে। কিন্তু ‘নব বাবু বিলাস’ এর সঙ্গে আলালের তফাৎ হলো তৎকালীন তিনি শুধু সমাজের ভ্রষ্টাচারের চিত্রই অঙ্কিত করেন নাই, গ্রন্থটির মধ্যে তিনি একটি ইতিবাচক দিকও স্বার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। বাবু রাম বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রাম লালের উত্তম চরিত্র হওয়ার কাহিনী এবং জীবন বোধের জন্য প্যারী চাঁদ মিত্র সে আমলে মুক্ত ভাবাদর্শ ও উত্তম জীবন বোধ দ্বারা পরিচিত হয়েছিলেন। সুতরাং কাহিনীর দিক থেকে প্যারী চাঁদ মিত্রের আলাল ও তৎকালীন সমাজে একটি বাস্তব জীবন বোধকে তার সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন লেখনির মাধ্যমেই সমাজের কাছে নব্য বাঙাল জাতির কাছে স্বার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন। সুতরাং এই উপন্যাসের স্বয়ং নায়ক মতিলাল, উকিল বটলার ও মুহুরী বানছা রামের চরিত্র সে সময়ে সমাজে আশ্চর্য দক্ষতা ও নিপুণতার পরিচয় দিয়েছে। প্যারী চাঁদ মিত্রকে সে যুগেও শ্রেষ্ঠ বাঙালীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। একাধারে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় সমাজকর্মী, সফল ব্যবসায়ী ও প্রথিতযশা সাংবাদিক। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নবেম্বর ৬৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি নানা প্রতিষ্ঠানে বহু কল্যাণকর ও গঠনমূলক সেবা কার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসে বিশেষত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কলকাতা ও তার নগর কেন্দ্রিক সামজিক চিত্র আশ্চর্য নিপুণতহার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্যারী চাঁদ মিত্রকে দান করেছে অমরতা ও বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে এক যুগান্তকারী স্বর্ণ শিখরের স্বার্থক রূপায়ন।
×