ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফেঁসে গেল দুই প্রবাসী বাংলাদেশী

শাহজালাল দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে ব্যাঙ্ককে মুদ্রা পাচার

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১৫ নভেম্বর ২০১৮

শাহজালাল দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে ব্যাঙ্ককে মুদ্রা পাচার

আজাদ সুলায়মান ॥ ঢাকা থেকে নির্বিঘ্নে ব্যাঙ্ককে হুন্ডির মাধ্যমে দেশী-বিদেশী মুদ্রা পাচার করা হচ্ছে। পাচারের মুদ্রায় কেনা হয় সোনা, মাদক ও ওষুধ। অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে টাকাসহ অন্য মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাঙ্কক প্রবাসী কয়েক বাংলাদেশী। এ সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ককে রেস্তরাঁ ও ট্রাভেলস ব্যবসার আড়ালে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে চোরাচালান করছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘেœ তারা পাচার করছে মুদ্রা- আর দেশে আনছে সোনা ও অন্যান্য পণ্য। সম্প্রতি ব্যাঙ্কক পুলিশের হাতে আটক আনোয়ার হোসেন নামের এক পাচারকারী এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে। এ বিষয়ে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট তদন্ত করছে। এ সংক্রান্ত চিঠিতে দেখা যায়, আনোয়ার সম্প্রতি নাজমুল নামের ব্যাঙ্ককপ্রবাসী অপর এক বাংলাদেশীর টাকা চুরি করে ধরা পড়ে। সে ঘটনায় তদন্ত করতে গিয়ে ব্যাঙ্কক পুলিশ কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মতো কাহিনী জানতে পারে। ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১ এপ্রিল ব্যাঙ্ককের বুপারাম পুলিশ স্টেশনে নাজমুল হাসান নামের এক বাংলাদেশী তার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চুরির অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, সেদিনই ব্যাঙ্ককের একটি মসজিদে বসে থাকা অবস্থায় আনোয়ার হোসেন নামের একজন বাংলাদেশীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তিনি তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তার কাছে একটা ব্যাগ রেখে টয়লেটে যান। মিনিট দশেক পর এসে দেখেন আনোয়ার হোসেন ওই ব্যাগ নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। ব্যাগে ছিল ৩১ হাজার ইউরো, ৪ লাখ দিরহাম ও ৮ লাখ সৌদি রিয়াল। ব্যাঙ্কক পুলিশ এ অভিযোগ হাতে নিয়ে মাঠে নামে। আনোয়ারকে ধরার জন্য গোয়েন্দা মোতায়েন করে। ইমিগ্রেশনেও তার সম্পর্কে ওয়ান্টেড নোটিস পাঠায়। ঘটনাক্রমে পরদিনই আনোয়ার অপর একটি ফ্লাইটে ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্ট থেকে নেপাল যাওয়ার জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পেরিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাওয়ার পরই তাকে আটকে দেয়া হয়। এ সময় তার ব্যাগ থেকে নাজমুলের চুরি যাওয়া মুদ্রাগুলো উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে তাকে থানায় পাঠানো হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আনোয়ার জানায়, এগুলো নাজমুলের কাছ থেকেই চুরি করা মুদ্রা। ব্যাঙ্কক থেকে সরাসরি ঢাকায় না এসে নেপাল হয়ে সড়কপথে ফেরার পরিকল্পনা ছিল তার। আনোয়ার আরও জানায়, এগুলো মূলত কোন বৈধ মুদ্রা নয়। ঢাকা থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে নাজমুল হাসান ব্যাঙ্কক নিয়ে যায়। আনোয়ারের দেয়া তথ্যমতে, নাজমুল পেশাদার হুন্ডি ব্যবসায়ী। ঢাকা থেকে প্রতি মাসেই ব্যাঙ্ককে তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশী ও সৌদিসহ অন্য দেশের মুদ্রা পাচারে জড়িত। ব্যাঙ্ককে তার সিন্ডিকেটের অপর সদস্য হচ্ছে- হাসান, তানিয়া ট্রাভেল ট্রেডার্সের মোহাম্মদ শাহীন আমীর ও নিউ কস্তুরি রেস্টুরেন্টের আশ্রাফ হাসানসহ আরও তিন ভারতীয়। তারাই কলকাতা, নেপাল ঢাকা হয়ে থাইল্যান্ডে হুন্ডি বাণিজ্যের বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এদিকে ব্যাঙ্কক পুলিশ নাজমুল হাসানকে কিভাবে এত মুদ্রা পাচার করা হয়েছে তা জানতে চেয়েছে। নাজমুল তখন ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে এই মুদ্রার ঘোষণা দেয়ার কাগজপত্র প্রদর্শন করেন। তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- ঢাকা থেকে এ মুদ্রা নিয়ে কিভাবে ফ্লাইটে ওঠেছেন। জবাবে নাজমুল কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এ বিষয়ে ঢাকায় সিআইডি পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে- ওই তারিখে নাজমুল নামের একজন যাত্রী হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ব্যাঙ্কক গেছেন। তবে ঢাকা কাস্টমস হাউসে সেদিন নাজমুল নামের কোন যাত্রী উল্লেখিত মুদ্রার ঘোষণা দেননি। শাহজালাল বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোন ডকুমেন্টস নেই। এতে সিআইডি পুলিশ নিশ্চিত হয়- নাজমুল এত বিপুল পরিমাণ মুদ্রা শাহজালাল দিয়েই ব্যাঙ্কক নিয়ে গেছে। ঢাকা থেকে পুলিশ সদর দফতর ও সিআইডি ইউনিট ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরে এই মুদ্রা ঘোষণা দেয়ার ডকুমেন্টস চেয়ে পাঠিয়েছে। এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টসে দেখা যায়, ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরে নাজমুলের কাছে এত বিপুল পরিমাণ মুদ্রার উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়নি। এটাই সেদেশের রুলস। প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে ঘোষণা না দিয়ে ঢাকা থেকে কিভাবে মুদ্রার এ চালান পাচার করা হলো? সিআইডি পুলিশ জানিয়েছে, বরিশালের চুনারচর পাতারহাটের বাসিন্দা মিজানুর রহমান শিকদারের ছেলে নাজমুল হাসানের ঠিকানায় একাধিকবার খোঁজ নিয়েও তার সন্ধান মিলেনি। রাজধানীর ১১২ উত্তর মুগদাপাড়ায় তার এন আর এন্টারপ্রাইজের ঠিকানায় গিয়েও তালা ঝুলতে দেখা গেছে। মূলত ইলেকট্রনিক গুডস ব্যবসার আড়ালে সে দীর্ঘদিন ধরেই হুন্ডির মাধ্যমে চোরাচালানে জড়িত। ধারণা করা হচ্ছে- সে গা ঢাকা দিয়েছে। একইভাবে সাভারের পশ্চিম রাজাসনের আরশাদ আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেনের বাসার ঠিকানায়ও নজরদারি রয়েছে। তারও কোন হদিস মিলছে না। বিমানবন্দরের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যে দু’একটা চালান ধরা পড়ে-সেগুলো পাচারের তুলনায় খুবই স্বল্প। এতগুলো সংস্থা এখানে সক্রিয় থাকার পরও হুন্ডির মাধ্যমে মুদ্রা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। ব্যাঙ্ককে আটকের পর আনোয়ার কিছুদিন জেল খাটার পর জামিনে বেরিয়ে দেশে ফিরে আত্মগোপনে চলে যায়। তাকে ভালভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে এই হন্ডি পাচারের নেপথ্য নায়কদের ধরা সহজ হতো। এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার ওথেলো চৌধুরী বলেন, টাকা পাচারের এই তথ্য আমাদের কাছে নেই। অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে জানা সম্ভব হতো কিভাবে বিমানবন্দর দিয়ে এ টাকা পাচার করেছে তারা। সাধারণত শাহজালালের প্রতিটি বহির্গামী গেটেই শুল্ক সদস্যরা ডিউটি করেন। যদিও জনবলের অভাবে অনেক সময়েই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও এ ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে তদন্ত করে দেখা যাবে কিভাবে কোন ফ্লাইটে ওই যাত্রী এত মুদ্রা পাচার করেছেন। জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো এ ধরনের চালান হয়তো ধরা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন উপায়ে এ ধরনের মুদ্রা পাচারকারীদের ধরতে।
×