ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার দুই বছর পূর্তি

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১ জুলাই ২০১৮

আজ হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার দুই বছর পূর্তি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আজ রবিবার। হলি আর্টিজানে ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গী হামলার দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে। নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। শ্রদ্ধা নিবেদন ও ইতিহাসের বিষাদময় সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি দেখার জন্য সেখানে ভিড় করবেন দেশী-বিদেশী অনেকেই। এজন্য আজ সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটা পর্যন্ত চার ঘণ্টার জন্য খোলা রাখা হচ্ছে বাড়িটি। আগতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শনিবার দুপুর থেকেই ওই বাড়িসহ আশপাশের এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। আশপাশে বসানো হয়েছে অসংখ্য চেকপোস্ট। প্রবেশের প্রতিটি রাস্তায়ই বসানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যারিকেড। আজ ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে ভিড় করবেন দেশী-বিদেশীরা। সকাল থেকেই শুরু হবে শ্রদ্ধা নিবেদন। শনিবারও অনেকেই সেখানে গিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে বেরিয়ে গেছেন। অনেক বিদেশী তাদের স্বজন হারানোর জায়গাটি দেখার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। শনিবারও হলি আর্টিজানের পরিবেশ ছিল থমথমে। নির্জন রেস্তরাঁটি যেন একাই নিজের সঙ্গে নিজেই দুঃখের কথা বলে যাচ্ছে। বাতাসে তার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে। নীরবে রেস্তরাঁটি দাঁড়িয়ে আছে বুকে অসংখ্য বুলেটের ক্ষত নিয়ে। শত শত বুলেটের চিহ্ন রয়েছে দেয়ালে। যদিও তার ওপর রঙের প্রলেপ পড়েছে। তবে ভেতরের ক্ষত শুকোয়নি। অনেকে বুলেটবিদ্ধ হয়ে ভেতরেই রয়ে গেছে। সামনের সবুজ মাঠ আবার সুন্দর হয়েছে। তবে সেই সৌন্দর্য দেখার কেউ নেই। কারণ, এখনও অনেকেই সেখানে গেলে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। পাশের লেকভিউ ক্লিনিকটি খুলেছে। নিরাপত্তাকর্মীরা বলছিলেন, আগের মতো আর রোগীর আনাগোনা নেই। বিশেষ করে বিদেশীরা তো ভুলেও এই পথই মাড়ান না। লেকের দিকে যাওয়ার রাস্তার গেটটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যার পর হলি আর্টিজানের রূপ ভুতুড়ে হয়ে যায়। তাই অনেক নিরাপত্তাকর্মী গেটের বাইরে অবস্থান নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। জঙ্গীরা নৃশংসভাবে দেশী-বিদেশীদের হত্যার পর ভয়ে আর সেই বাড়িতে কেউ থাকেন না। বাড়িটি থাকার জন্য উপযোগী করা হলেও তাতে থাকে না বাড়ির মালিক সাদাত মেহেদীর পরিবারও। তাই ভুতুড়ে বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে অতৃপ্ত আত্মারা। তারাই বিচরণ করছে। সাদাত মেহেদীর স্ত্রী সামিরা আহমেদ উত্তরাধিকারসূত্রে বাড়ির মালিক। ১৯৭৯ সালে আবাসিক ভবন কাম ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য ডাঃ সুরাইয়া জাবিনকে বরাদ্দ দেয়া হয় বাড়িটি। ১৯৮২ সালে ওই প্লটের দক্ষিণ দিকে গড়ে ওঠে লেকভিউ ক্লিনিক। ডাঃ সুরাইয়ার মৃত্যুর পর প্লটের মালিক হন তারই দুই মেয়েÑসামিরা আহমেদ ও সারা আহমেদ। সামিরার স্বামী সাদাত মেহেদী আর তার বন্ধু নাসিমুল আলম পরাগসহ কয়েকজন মিলে ২০১৪ সালের জুনে বাড়িটিতে গড়ে তোলেন হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তরাঁ। হামলার ছয় মাস পর গুলশান এভিনিউর ্যাংগস আর্কেডের দোতলায় স্বল্প পরিসরে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ নতুন করে চালু করা হয়। সেখানে পুরনো বেকারির পাঁচ কর্মচারীসহ মোট আটজন কাজ করেন। আর্টিজানে যাওয়া অনেক বিদেশী নানা কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তারা প্রথম প্রথম হলি আর্টিজানে হামলার পর বাংলাদেশে আইএস আস্তানা গেড়েছে বলে ভেবেছিলেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনেক হামলা হতে পারে বলেও তাদের ধারণা ছিল। এজন্য ঘটনার পর পরই তারা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সরকারের জঙ্গী দমনের প্রেক্ষিতে এবং সার্বিক বিষয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে; এখানে কথিত ‘আইএস’ আতঙ্ক বলে কিছু নেই। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। এজন্য বিদেশীরা আবার বাংলাদেশে এসেছেন। শুধু তারা নন, চলে যাওয়া অনেক বিদেশীই আবার বাংলাদেশে ফিরেছেন। তবে তাদের মন থেকে ভয় যে একেবারেই কেটে গেছে, তা নয়। কিছুটা আতঙ্ক তাদের এখনও কাজ করে। নৃশংস ওই জঙ্গী হামলার পর দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে বলে নানাভাবে প্রপাগান্ডা চালানো হয়। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশে আইএস তৎপরতা রয়েছে দাবি করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত তদন্তে বেরিয়ে আসে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবিরই নতুন একটি অংশ; যেটি নব্য জেএমবি হিসেবে পরিচিত, তারাই হামলাটি চালিয়েছে। শেষ অবধি বাংলাদেশে যে আইএস নেই, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। হামলার পরদিন ভোরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে হামলাকারী জঙ্গী নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হয়। অভিযানে রেস্তরাঁর পাঁচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে তিন বিদেশীসহ ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করেন। সবমিলিয়ে জিম্মিদশা থেকে ৩৩ জনকে জীবিত উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, আব্দুল্লাহ মোতালেব, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজানসহ অনেকেই পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে নিহত হয়েছে। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণে জড়িত জেএমবির শীর্ষ নেতা টু-া মাহফুজ। ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া জানান, হলি আর্টিজানে হামলার পর সারাদেশে চালানো জঙ্গীবাদ বিরোধী ৬০ অভিযানে অন্তত এক শ’ জঙ্গীর মৃত্যু হয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যেই এ হামলার চার্জশীট দাখিল দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
×