ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অস্থিরতা নিরসনে

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৭ জুন ২০১৮

অস্থিরতা নিরসনে

দেশের ব্যাংকিংখাতে অস্থিরতা কমছে না। সেই সঙ্গে খেলাপী ঋণের সংস্কৃতির ঘটছে বিস্তার। অথচ দেশে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এসব বাধাবিঘœ অতিক্রম করা সঙ্গত আজ। সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশে যাত্রা পথের কাঁটাগুলো উপড়ে ফেলার বিকল্প নেই। এটা তো স্মর্তব্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা শাসকরা নিজেদের ক্ষমতাকে বহাল রাখার খায়েশে আর্থিক খাতকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পতিত করেছিল। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটিয়েছে পঁচাত্তর পরবর্তী জান্তা, তার রেশ এখনও মিলিয়ে যায়নি। বাণিজ্যও মানসজগতে তার অবস্থান বিদ্যমান। জিয়া ও এরশাদ নামক দুই ক্ষমতা দখলকারী জান্তা দেশে দুর্নীতির বিস্তার ঘটাতে ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়ম, নৈরাজ্য ও অনাচারকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তাতে দেশে আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা তীব্রতর হয়েছে। ব্যাংকের টাকা অবাধে বিতরণ করে ‘লুটেরা’ শ্রেণী তৈরি করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করে বঙ্গবন্ধু যখন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তাকে হত্যা করা হয় সপরিবারে। দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য একাত্তরের পরাজিত শক্তির উত্থান ঘটানো শুধু নয়, তাদের আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যাংক থেকে দেদার অর্থ বিতরণ করা হয়। দেশে গড়ে তোলা হয় সুবিধাভোগী শ্রেণী। যাদের লক্ষ্যই লুটপাট করা। আর শুরু হয় খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার প্রবণতা তখন হতেই বাড়তে থাকে। এমনকি ঋণের সুদ মৌখিক নির্দেশেও বাতিল করা হতে থাকে দুই সামরিক শাসকের গণবিরোধী মানসিকতার ধারাবাহিকতায় জিয়ার উত্তরসূরি বিএনপির চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুস সাত্তার একতরফা ভোটে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষিত হওয়ার পর ক্ষমতায় বসে যে নৈরাজ্যকর অবস্থায় তৈরি করেছিলেন, তার মাশুল আজও গুনতে হচ্ছে। এক রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের দশ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা না করেই। ক্ষমতার মানদ-ে এহেন অপকর্ম সাধন করা হয়। অতীতের সেই সব অনাচারের সংস্কৃতি সহজে বিলোপ হওয়ার নয় বলেই ক্ষমতা দখলকারী অপর সামরিক শাসক এরশাদ ব্যাংকিং খাতকে অস্থির করে তুলেছিলেন। বশংবদ তৈরি করার লক্ষ্যে যাকে খুশি তাকে ব্যাংক ঋণ বরাদ্দ করতে থাকেন। যে ঋণের অর্থ আর ফেরত আসেনি, সুদ দূরে থাক। এভাবেই খেলাপী ঋণের পরিমাণ দেদার বাড়তে থাকে। দেশের আর্থিক অবস্থা এতই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, বিদেশী সাহায্যনির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বৈদেশিক ঋণ প্রবাহও বৃদ্ধি পায়। এমনকি এই অর্থও নয়ছয় করা হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানও বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে আজ যে অস্থিরতা ও খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি বিদ্যমান তা বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারে সৃষ্ট নয়। বরং এটা অনেক বছরের জিইয়ে রাখা একটা সমস্যা। জিয়াউর রহমানের শাসনামল থেকে এর শুরু। এরপর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ সমস্যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এটা তো বাস্তব যে, অতীতের সেই নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা থেকে আর্থিক খাতকে উদ্ধার করার জন্য বর্তমান সরকার তার নয় বছরের বেশি সময় ধরে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খেলাপী ঋণ নামক সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করতে চাইছে। দেশে সরকারী ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারী খাতে চারগুণ বেশি ব্যাংক রয়েছে। যারা আর্থিক মুনাফার লাভবান হলেও বিধিবিধান যথাযথভাবে মেনে চলছে বলা যাবে না। অনেক ব্যাংক মালিকই যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করাতে পারছেন না। তাই ব্যাংক খাত সংস্কার সাধন জরুরী হয়ে পড়ছে। কীভাবে করা যায় সে সব আরও বিশ্লেষণ জরুরী। জনগণের আমানতের অর্থ নয়ছয় করে কতিপয় লোক বিত্তবান হয়ে ওঠার এই অন্যায় পথও পন্থা চিরতরে বন্ধ করা হবেÑ এই প্রত্যাশা।
×