ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

সুমন জাহিদ ॥ সাক্ষী সুরক্ষা আইন কোথায়?

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৫ জুন ২০১৮

সুমন জাহিদ ॥ সাক্ষী সুরক্ষা আইন কোথায়?

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টি অসমাপ্ত ছিল। বিশেষ করে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, দালাল, রাজাকার, হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী জামায়াতের নেতাদের এবং তাদের দ্বারা তৈরি আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির হত্যাকারীদের বিচার শুরু না হওয়া পর্যন্ত। সে জন্য এ বিজয়কে আমরা অসমাপ্ত গণ্য করতাম। ’৭৫ স্বাধীনতাকামীদের জন্য একটি অন্ধকার আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের উত্থানের মাইলফলক অধ্যায় হয়ে রইল। ’৭১ যদি হয় ‘আলোকোজ্জ্বল নতুন প্রভাতের উদয়ের মাইলফলক’, তাহলে ’৭৫ সেই আলোক-উৎসের অস্তের ফলে গভীর অন্ধকারের শ্বাপদের উত্থানের মাইলফলক। যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধী মিত্রদের দীর্ঘ সময়ের রাজত্বকালে ইতিহাসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গর্ব, অহঙ্কার, কীর্তিগাথা, বীরত্ব, গৌরব, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের জাতীয় বীর ও মুক্তিযোদ্ধাদের এ দীর্ঘ সময়ে একে একে ধুলায় ধূসরিত হয়ে ইতিহাস থেকে মুছে যেতে দেখেছি। তারপর একদিন ২০০৮-এ আকস্মিকভাবে অন্ধকারের দানব ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, তাদের আদর্শগত মিত্রদের পরাভূত করে আরেকবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী দলগুলো, ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিকারী সব প্রগতিশীল সংগঠন এবং নতুন প্রজন্ম বিপুল ভোটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী জোটকে বিজয়ী করে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। এর আগে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অল্প পার্থক্যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। যদিও দলটি তখন দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সফলভাবে কাজ করছিল, কিন্তু সেগুলোর প্রতি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির বাধা, আন্দোলন, নাশকতামূলক কর্মকা- নানাভাবে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তারপর আবারও অন্ধকারের দানবরা বিশাল এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১-এর নির্বাচনের বিজয় ছিনিয়ে নেয়। এ কারণে ২০০৮-এর নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের জোটের দুই-তৃতীয়াংশ সিটে বিজয় ’৭৫-এর পর বাঙালীকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ সুগম করে দিয়েছিল। উপরন্তু, খালেদা-তারেকের দুর্নীতি, জঙ্গী উত্থান ও হত্যার রাজনীতি এবং দুঃশাসনের ফলে বিএনপি ওই নির্বাচনে অল্প কিছু সিট পাওয়ায় এবং তারা যেহেতু সংসদকে অকার্যকর রাখায় বিশ্বাসী, সে কারণে বিএনপি ছিল সংসদে পুরো সময়জুড়ে অনুপস্থিত। এদিকে, দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় পদে বিজয় মহাজোটের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত জাতীয় জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ-’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনকে সম্ভব করে। জামায়াত, আলবদর বাহিনীর বড় বড় যুদ্ধাপরাধী নেতা- গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, সাকা চৌধুরী, সাঈদী, আবদুল আলিম, চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খানদের অধিকাংশকেই গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে শহীদ পরিবারের স্ত্রী ও সন্তানদের সাক্ষ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের অকাট্য প্রমাণ। ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রদত্ত এই সাক্ষ্য ছিল অপরাধের প্রধান প্রমাণ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত সাক্ষীদের জীবনের সুরক্ষার লক্ষ্যে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ প্রজন্ম ’৭১ ও তরুণ প্রজন্মের পরবর্তী দাবিÑ ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফত আইন’ প্রণয়নের দাবি আইনমন্ত্রীর বারবার প্রদত্ত আশ্বাস সত্ত্বেও এখনও কেন এই আইন দুটি সংসদে পাস হলো নাÑ এ প্রশ্ন আজকে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র পুত্রসুমন জাহিদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু আবারও আমাদের বিদ্ধ করছে। কেন শহীদের সন্তানের এমন মৃত্যু হবে? এই ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইনটির প্রয়োজন প্রথম নির্মূল কমিটি উপলব্ধি করে যখন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একই এলাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে তার বাসগৃহে প্রবেশ করে সাঈদীপন্থী গুপ্ত ঘাতক হত্যা করে। এরপর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারী গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। বছর দুয়েক আগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানকারী মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মিরাজ আহমেদের মৃতদেহ কুড়িল রেললাইনের পাশে পাওয়ায় যায়। এরই ধারাবাহিকতায় শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের বেঁচে যাওয়া ’৭১-এ আট বছরের সন্তান সুমন জাহিদ যাকে রান্নারত মা আলবদরদের সঙ্গে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘আমি এসে ভাত দেব’, সেই মাহারা পুত্র দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে শিক্ষা শেষে ব্যাংকে, টিভি চ্যানেলে চাকরি করতে সক্ষম হয়। উপরন্তু ট্রাইব্যুনালে তার মায়ের খুনী আলবদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সাক্ষ্য দিয়েছিল, তার এমন মৃত্যু কেন হলো? এমন মূল্যবান সাক্ষ্য অনেক শহীদের স্ত্রী, ভাই ও সন্তানরা দিয়েছিল বলে ’৭১-এর বড় বড় যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচার ও দ- প্রদান দীর্ঘদিন অসম্ভব মনে হয়েছিল, সেটিকে সম্ভব করে জাতিকে এরা কলঙ্কমুক্ত করেছে- এ কথা ভুলে গেলে হবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কেন কিভাবে সুমন জাহিদ নিহত হলো? ১. শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের পুত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আলবদর খুনী চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার কারণে সে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্র কারোর ইঙ্গিতে জঙ্গীদের হাতে খুন হয়েছে কি? প্রমাণ হিসেবে বলা যায় তাকে প্রায়ই হত্যার হুমকি কারা দিত? কার বা কাদের স্বার্থকে সুমন জাহিদের সাক্ষ্য আঘাত করেছিল? ২. সকালে কার ফোন পেয়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল? নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ। তার মোবাইল ফোনটি চুরি না হলে সেটি থেকে গোয়েন্দা পুলিশ খুব সহজে তথ্য, কথোপকথনের রেকর্ড বের করতে পারবে, তাই নয় কি? ৩. যে ছোট মেয়েটি ও তার মাকে খুব সম্ভব কেউ শিখিয়ে, পড়িয়ে, হুমকি দিয়ে একটি গল্প প্রকাশ করেছে, সে গল্প কি বিশ্বাসযোগ্য? রেললাইনে প্রকাশ্য দিবালোকে বহুজনের সামনে, এমনকি ওই মেয়েটির ৫-৬ জন খেলার সঙ্গীদের সামনে সুমন জাহিদ আত্মহত্যার পদক্ষেপ নিয়েছে বলে বর্ণিত গল্পটি কি বিশ্বাসযোগ্য? তাহলে অন্য ছেলেমেয়েরা, লোকজন কেউ ওকে দেখতে পেল না কেন? ৪. মেয়েটির গল্প সূত্রে-এক ব্যক্তি রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে ছেলেমেয়ে, মানুষজনের সামনে রেললাইনে মাথা পেতে শুয়েছে, মেয়েটি যার দু’পা ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করেছে, ব্যক্তিটি তাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করে- এ কেমন গল্প? মেয়েটির সঙ্গে তার সঙ্গীরা সবাই এ দৃশ্য দেখে তাদের চিৎকারে বড়রা, নারী-পুরুষরা একত্রে ব্যক্তিটিকে সরিয়ে নেবে না- এ কি করে হয়? ফলে অনেক ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষ এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হবে নাকি? ৫. যে মাহারা ছেলেটি জীবন সংগ্রামে নেমে সিএনজি চালিয়ে লেখাপড়া করেছে, ব্যাংকে, কোন চ্যানেলে চাকরি করেছে, বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, দুই পুত্রের পিতা হয়েছে, যারা এখনও পড়াশোনার মধ্য পর্যায়ে, সে কি আত্মহত্যা করতে পারে? ৬. বরং, ওর বিচ্ছিন্ন মৃতদেহের গলাটি ধারালো চাপাতির কোপে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যারা তার মৃতদেহ, বিচ্ছিন্ন মস্তক ও দেহ দেখেছে, তাদের অভিমত। তাছাড়া ও তো বারবার জঙ্গীদের, খুনীদের হুমকি পেয়েছে এবং সে এ ব্যাপারে সব সময় চিন্তিত থাকত বলে তার স্ত্রী-স্বজনরা জানিয়েছে। এটা তো ঠিক, ট্রাইব্যুনালে খুনী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে ওর নিজ প্রাণের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলেছিল, নয় কি? ৭. তাছাড়া, বর্তমান নির্বাচনী বছরে চৌধুরী মঈনুদ্দীন-তারেক গং নতুনভাবে লাশ ফেলার ষড়যন্ত্রে মাতেনি, তা উড়িয়ে দেয়া যায় না এবং এমন কাজ ওদের চারিত্রিক, আদর্শিক লক্ষ্য পূরণের জন্য সম্ভবপর বলে মনে হয়। এটা জানা কথা, ওরা সব সময় ‘দুর্বল টার্গেট’কে আঘাত করে এখনও। নির্বাচনী বছরের শুরুতে তারা সম্ভবত আরও কাউকে আঘাত করবে। সুমন জাহিদ নানা দিক থেকে বিচার করলে ‘দুর্বল টার্গেট’ হিসেবেই গণ্য হবে ধারণা করি। তাই সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন না হয়ে কি থাকা সম্ভব? এবার আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাব- ১. প্রথমত দ্রুততম সময়ে ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ ও ‘যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফত আইন’ পাস করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সাক্ষীদের এখনই সুরক্ষা দিতে হবে। ২. সুমন জাহিদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. ওই আত্মহত্যার গল্প বলা মেয়েটিকে, তার মাকে, তার সঙ্গে থাকা খেলার সঙ্গীদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, গল্পটির ক্রস চেক করে নানাভাবে প্রশ্ন করে, গল্প প্রণেতা নেপথ্য মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, সম্ভাবনা আছে, তাকে অন্য কোথাও খুন করা হয়েছে, তার নাকে-মুখে কাটা-ছেঁড়া তো তার বাধাদানের চেষ্টা থেকে প্রাপ্ত আঘাত বলেই প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া রেললাইনে আত্মহত্যাকারী সব সময় নির্জন রাতের অন্ধকারকে বেছে নেবে, তাই না? প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আমি কোটা আন্দোলন নিয়ে লিখেছিলাম, ’৭৫-এর পর প্রায় ৩০ বছর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার কিছুই পায়নি। তা না হলে শহীদ সেলিনা পারভীনের একমাত্র পুত্রকে সিএনজি চালিয়ে নিজ ব্যয় বহন করতে হবে কেন? আশা করব সুমনের মৃত্যুর সঠিক, সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বের করার নির্দেশ দেবেন এবং রাষ্ট্র সুমনের দুই পুত্রের পড়াশোনা ও পরিবারের ব্যয়ভার বহন করবে এবং আমাদের সাক্ষীদের নিরাপত্তা প্রদানের অক্ষমতার লজ্জা থেকে সাক্ষী সুরক্ষা আইন পাস ও বাস্তবায়ন করে কিছুটা রেহাই দেবেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×