ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক স্বপ্নবাজ দুষ্ট বালক রাহিম স্টার্লিং...

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৪ জুন ২০১৮

এক স্বপ্নবাজ দুষ্ট বালক রাহিম স্টার্লিং...

রুমেল খান ॥ মানুষ তার জীবনের ৩৩ শতাংশ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। স্বপ্ন মানুষের ঘুমন্ত জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। নিদ্রিত অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলো স্তিমিত হয় কিন্তু সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয় না। তাই ঘুমের সময়টাতে নানারূপ কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা ও দৃশ্য উদিত হয়। এসব দৃশ্য দেখাকে একরকমের ‘স্বপ্ন দেখা’ বলা হয়। নিদ্রিত অবস্থায় জাগ্রত অবস্থার ধারাবাহিকতাকেও স্বপ্ন বলা যেতে পারে। রাহিম শাকুইলি স্টার্লিংও স্বপ্নচারী এক ফুটবলার। বিচিত্র তার জীবন। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং ২৩ বছর বয়সী রাহিমের জীবন বড়ই বিচিত্র। স্বভাব-চরিত্রও তাই। যাকে ইংলিশ ট্যাবলয়েড প্রেসগুলো আখ্যা দিয়েছে ‘দুষ্ট বালক’ হিসেবে। কারণ এই অল্প বয়সেই অনেক স্ক্যান্ডালের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তারপরও সে সবকে পাত্তা না নিয়ে চলতি বিশ্বকাপে ভাল খেলে দলকে সাহায্য করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে ইংলিশ ট্যাবলয়েডগুলো অনেক আজেবাজে খবর ছাপায়। এ গুলোর সবগুলোই মিথ্যে। আমাকে এসব মোটেও প্রভাবিত করে না। আমার স্বপ্ন একটাইÑ রাশিয়া বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে আমার পরিবারের সমর্থন। আর এ জন্য যদি আমাকে ইংল্যান্ডের দুষ্ট বালকের খেতাবও পেতে হয় তাতেও আমার কোন আপত্তি থাকবে না।’ স্টার্লিংয়ের জন্ম ১৯৯৪ সালের ৮ ডিসেম্বর জ্যামাইকার কিংস্টনের ম্যাভারলিতে। জন্মসনদে বাবার নাম না থাকায় রাহিম বড় হন তার মায়ের বংশীয় নামে। মা নাদাইন স্টার্লিংয়ের ‘স্টার্লিং’ নামটি পান আগের স্বামী এ্যারল স্টার্লিংয়ের কাছ থেকে। যখন তার বয়স ৯, তখন তার বাবা জ্যামাইকায় খুন হন স্থানীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে। বাবার মৃত্যুর পর আক্রমণকারীদের হাত থেকে রাহিমকে বাঁচাতে তার বড় সৎ বোন তাকে কয়েক মাস লুকিয়ে রেখেছিলেন। জ্যামাইকায় রাহিমকে পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশাও দেখতে হয়েছে অনেক। মা কাজ করতেন পার্লারে। আত্মীয়-স্বজনরাও ছিল খুবই গরিব। রাহিমকে সামান্য একটি ফুটবল কিনে দেয়ারও সামর্থ্য ছিল না তাদের। এর বিকল্প হিসেবে জুসের কার্টন দিয়ে ফুটবল খেলতেন রাহিম। জ্যামাইকায় এমন প্রতিকূল অবস্থায় নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মা নাদাইন রাহিমকে নিয়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। অন্যতম প্রতিকূল শহর উত্তর-পশ্চিম লন্ডনে প্রথমে তিনি একাই যান। কেননা তিনি রাহিমের সব খরচ বহন করতে অক্ষম ছিলেন। প্রথমে তিনি তার সন্তানের জন্য আবাসন ও খেলার সব সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করছিলেন। সে সময়ে রাহিম ছিলেন জ্যামাইকায় তার খালার বাসায়। ইংল্যান্ডে এসে রাহিম ভর্তি হন ওয়েম্বলির কোপল্যান্ড স্কুলে। সহিংস আচরণের কারণে অনেক স্কুল বদলাতে হয় রাহিমকে। ৯ বছর বয়সেই ফুটবল প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটে রাহিমের। ফলে এই উইঙ্গার/এ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ওপর চোখ পড়ে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের। এই ক্লাবের যুব দলে খেলেন ২০০৩-২০১০ সাল পর্যন্ত। এরপর লিভারপুলের যুব দলে খেলেন ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত। এরপর লিভারপুলের মূল বা সিনিয়র দলে যোগ দেন ২০১২ সালেই। খেলেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ১২৯ ম্যাচ খেলে করেন ২৩ গোল। ২০১৫ সালে যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। এই ক্লাবের হয়ে দুটি শিরোপা জেতার পাশাপাশি ১৪০ ম্যাচ খেলে করেন ৪৪ গোল। রাহিম ম্যানসিটিতে যোগ দিয়ে আলোচিত হন ট্রান্সফার ফির জন্য। তারজন্য আগে থেকেই ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড চাচ্ছিল লিভারপুল, ম্যানসিটিও প্রায় সেই পরিমাণ অর্থই (৪৯ মিলিয়ন পাউন্ড) দিতে রাজি হয়। এর ফলে কম বয়সেই তারকাখ্যাতি পেয়ে যাওয়া রাহিম অনেকগুলো রেকর্ড গড়ে ফেলেন। যেমন : ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে দামী অ-২১ খেলোয়াড়, ১৩তম সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়, সবচেয়ে দামী ইংলিশ খেলোয়াড়, গ্যারেথ বেলের পর সবচেয়ে দামী ব্রিটিশ খেলোয়াড়, সুয়ারেজ ও তোরেসের পর লিভারপুলের সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রীত খেলোয়াড়, ম্যানসিটির সবচেয়ে দামী সাইনিং ...। ২০০৯ সালে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের যুব দলে খেলার সময়েই ইংল্যান্ড জাতীয় অ-১৬ দলে ডাক পান তিনি (৭ ম্যাচে ১ গোল), ২০১০ সালে অ-১৭ (১৩ ম্যাচে ৩ গোল), ২০১২ অ-১৯ (১ ম্যাচে ০ গোল), ২০১২-১৩ সেশনে অ-২১ (৮ ম্যাচে ৩ গোল) দলে খেলেছেন। ২০১২ সালেই ডাক পান জাতীয় বা সিনিয়র দলে। তবে ৩৮ ম্যাচে এখন পর্যন্ত করেছেন মাত্র দুই গোল। দশ বছর ফুটবল ক্যারিয়ারে একগাদা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন রাহিম। ১৮ বছরের এক তরুণীকে নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। ম্যানসিটিতে খেলার সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে যৌন কেলেঙ্কারির খবরও রটিয়েছিলেন তিনি। সাবেক এক প্রেমিকাকে হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার হন। পাইপমুখে শিশা-ধোঁয়া ছড়িয়ে সমালোচিত হন। বর্ণবৈষম্য ও গায়ে আঁকা ট্যাটুর জন্যও কম ভুগতে হয়নি রাহিমকে। একবার তো ম্যানসিটিরি মাঠের বাইরেই রাহিমকে আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল এই ট্যাটুর জন্য। সর্বশেষ নিজের ডান পায়ে বন্দুকের ট্যাটু এঁকে সমালোচিত হয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে যদি ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হতে পারে তাহলে রাহিমের সব অপকর্ম ক্ষমা করে দেবে ইংলিশ ট্যাবলয়েডগুলোই, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে স্বপ্নবাজ দুষ্ট বালক রাহিমের ভাগ্যে কি সেটা আছে?
×