ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বস্তির ঈদযাত্রা ॥ দুর্ভোগ কমেছে

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৫ জুন ২০১৮

 স্বস্তির ঈদযাত্রা ॥ দুর্ভোগ কমেছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। দেখা হবে প্রিয়জনের সঙ্গে। কথা হবে। হবে কথার আদান-প্রদান। একসঙ্গে হবে সবাই। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এদিনগুলোর জন্য কতই না অপেক্ষা। দেখা হবে...। দেখা। তাই তো কিছুটা ঝক্কি নিয়ে হাসিমুখে বাড়ির পানে ছুটছেন মানুষ। তবে সড়কপথে যে রকম দুর্ভোগের আশঙ্কা করা হয়েছিল তা হয়নি। অনেকটা স্বস্তিতেই বাড়ি ফিরছেন সবাই। যদিও সড়কপথের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে অনেকেই ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করেছিলেন। তাই তো রেলপথে ঘরমুখো মানুষের বাড়তি চাপ। এতটাই বেশি যে টিকেট কেটেও অনেকেই আসনে বসার সুযোগ পাননি। ট্রেন ও বাসের ছাদে বিপুল পরিমাণ মানুষকে ঈদযাত্রায় শামিল হতে দেখা গেছে। এদিকে রাজধানী ঢাকা শহর একদমই ফাঁকা। একেবারেই অন্যরকম রাজধানী। ব্যস্ততম শহরের চিত্র যেমন থাকে এর ছিটেফোঁটাও নেই। উপচেপড়া ভিড় হয়েছে কমলাপুর ॥ শেষ কর্মদিবসে ঈদে বাড়ি যাওয়ার পঞ্চম দিনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় হয়েছে ঢাকার (৪ কমলাপুর রেল স্টেশনে। এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি ট্রেনেই ছিল ভিড়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের প্রতিটি ট্রেন ছিল যাত্রীতে ঠাসা। আসন ছাড়াও ট্রেনের ভেতরে দাঁড়িয়ে, পাদানিতে ঝুলে, ইঞ্জিনের সামনে-পেছনে আর ছাদে চড়ে বাড়ির পথ ধরেছেন মানুষ। ঈদের দুদিন আগে বৃহস্পতিবার পাঁচটি বিশেষ ট্রেনসহ মোট ৬৯টি ট্রেন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা। বেলা ৩ পর্যন্ত কমলাপুর স্টেশন ছেড়েছে ৪০টি ট্রেন। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলগামী কয়েকটি ট্রেনের যাত্রায় দেরি বিষাদ ছড়িয়েছে যাত্রীদের মধ্যে। গরমের মধ্যে শিশুদের ভোগান্তি ছিল বেশি। চিলাহাটির নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি কমলাপুর ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৮টায়। যাত্রীদের অনেকে ভোর থেকেই স্টেশনে এসে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। ওমর ফারুক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, আমরা ট্রেনে সৈয়দপুর পর্যন্ত যাব। সেখান থেকে যেতে হবে বীরগঞ্জে। সকাল ৮টায় ট্রেন ছাড়লে সেটা বিকেল ৫টার দিকে সৈয়দপুর পৌঁছে। কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে রাত ৯টার মতো বেজে যাবে। রাতে যানবাহন পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। লালমনিরহাট ঈদ স্পেশাল ট্রেনের ছেড়ে যাওয়ার সময় বেলা সোয়া ৯টায়। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টায়ও ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে আসেনি। ওই ট্রেনের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন যাত্রীরা। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ৫৫ মিনিট দেরি করে ছেড়েছে। এছাড়া কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ২০ মিনিট পর ছেড়েছে। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলে তা ছেড়েছে ৭টা ২৫ মিনিটে। সকাল ৯টায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলে সেটি দেড় ঘণ্টা দেরি করে বেলা সাড়ে ১০টায় স্টেশন ছেড়ে যায়। দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেস ট্রেন আধাঘণ্টা দেরি করেছে। ট্রেনটি বেলা দশটার পরিবর্তে সাড়ে ১০টায় ছেড়ে যায়। যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় ট্রেন দেরি করছে বলে জানান কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক সিতাংশু চক্রবর্ত্তী। তিনি বলেন, পাঁচটি ট্রেন ছাড়া বাকিগুলো সময়মতো ছেড়ে গেছে। ধূমকেতু, সুন্দরবন ট্রেন দুটি দেরি করে স্টেশনে এসেছে। এজন্য এগুলো ছাড়তেও দেরি হয়েছে। যাত্রীদের চাপে একটি কোচে সমস্যা দেখা দিয়েছে, ফলে এটি পরিবর্তন করতে হয়েছে; এ কারণে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন দেরি করেছে। তাছাড়া যাত্রীদের ওঠা-নামায় সময় বেশি লাগায় তার প্রভাবেও ট্রেনের দেরি হচ্ছে বলে জানান তিনি। রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনে কাটা পড়ে পা হারিয়েছেন সোহেল রানা (৩০) নামে এক যুবক। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে চলন্ত ট্রেনে ওঠার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত সোহেলের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জে। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় নিয়ে জানতে চাইলে রেলপথ সচিব মোঃ মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরী। এক ঘণ্টা কিংবা ৩০ মিনিট বিলম্বে ট্রেন চলাচল করাটাকে খুব একটা দুর্ভোগ বলা যাবে না। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে নির্ধারিত গতির চেয়ে কমগতিতে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। তা ছাড়া প্রতিটি ট্রেনই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। একেকটি স্টেশনে নির্ধারিত যাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত সময় দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ভিড়ে যাত্রীদের ওঠানামায় বেশি সময় লাগছে। সড়কপথে দুর্ভোগ কমেছে ॥ এদিকে, ঈদযাত্রার পঞ্চম দিনে সড়কপথের যাত্রীদের তেমন কোন দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। বাসযাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তেমনটা হয়নি বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা। তবে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত মহাসড়কের বিভিন্নস্থান হাঁটুপানিতে ডুবে যাওয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলাচলকারী বাসগুলোর এক থেকে দুই ঘণ্টা বিলম্ব হয়। ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে বিশেষ করে গাবতলী থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত কিছুটা যানজটের মুখে পড়লেও অনেকটা স্বস্তি নিয়ে বাড়ি যেতে পেরেছেন বাসের যাত্রীরা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী বাস টার্মিনাল ও কল্যাণপুরের বাস কাউন্টারে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ে দূরপাল্লার বাসগুলো ছেড়ে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলমুখী বাসের কাউন্টার ব্যবস্থাপকরা জানান, বুধবার দুপুর পর্যন্ত মহাসড়কে বড় ধরনের কোন যানজটে পড়তে হয়নি। এই অবস্থা চালু থাকলে এবার ঈদযাত্রা স্বস্তিরই হবে। সড়কপথে ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ সহনীয় রাখতে গত ৮ জুন সড়কে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কের ভাঙ্গাচোরাও মেরামত করা হয়েছে। তবে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ‘সংস্কার’ কাজ অনেক এলাকাতেই ধুয়েমুছে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অংশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গতকাল দিনভর ধীরগতিতে গাড়ি চলেছে। কোথাও কোথাও যানজটও সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা অংশ সেই তুলনায় নির্বিঘœ ছিল। অনেকটা স্বস্তিতেই গাড়ি চলেছে। রংপুরের আগমনী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, স্বাভাবিক সময়ে রংপুর যেতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। গতকাল লেগেছে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা। ঈদযাত্রায় এক- দুই ঘণ্টার বিলম্বকে সহনীয় মনে করেন তিনি। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ইউনিক পরিবহনের ম্যানেজার নাসির উদ্দিন বলেন, সকালে যাত্রীর বেশি চাপ ছিল। দুপুরে তেমন যাত্রী নেই। তবে রাতে চাপ বাড়বে। পর্যাপ্ত গাড়ি রয়েছে। সঠিক সময় ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। তবে ঈদযাত্রায় মূল সমস্যা হয় মহাসড়কে যানজট থাকলে। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। সামনের দুদিন যানজট না থাকলে আশা করি কোন ঝামেলা হবে না। ভাড়া নৈরাজ্যের অভিযোগ ॥ ঈদযাত্রায় যাত্রীসাধারণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে দাবি করে অবিলম্বে এই নৈরাজ্য বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বৃহস্পতিবার আসন্ন ঈদযাত্রা পর্যবেক্ষণ কর্মসূচীতে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের গত কয়েকদিন ব্যাপী নগরীর বিভিন্ন বাস কাউন্টার, বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা বিনিময়কালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান। তিনি বলেন টিকেট অব্যবস্থাপনা, সড়ক অব্যবস্থাপনাসহ ঈদযাত্রার নানাক্ষেত্রে গলদ থাকায় যাত্রীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে। ভাড়া নৈরাজ্যে ও যাত্রী হয়রানি প্রতিরোধে বিআরটিএ ও বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় গতানুগতিক পদ্ধতিতে ভিজিল্যান্স টিম বা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে কোথাও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্ভোগের শিকার যাত্রীরা রাস্তায় কারো সহযোগিতা পাচ্ছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা যাত্রীরা রাস্তায় ইফতার বা সেহরি করতে পারছে না। দুর্ভোগের শিকার যাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে স্থানীয় সরকারের লোকজন ও সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আহব্বান জানিয়েছে যাত্রীস্বার্থ সংরক্ষণকারী এই সংগঠন। সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার নানা উদ্যোগ নেয়ার সত্ত্বেও অল্প সময়ে বিশাল যাত্রীবহর সামাল দেয়ার মতো জনবল বা প্রয়োজনীয় যানবাহন না থাকায় প্রতিবছর ঈদ আনন্দ যাত্রায় ভোগান্তি, হয়রানি, ভাড়া নৈরাজ্য, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানাভাবে যাত্রী সাধারণ হয়রানির শিকার হয়ে আসে। প্রতিবছর ঈদে গণপরিবহন সঙ্কটকে পুঁজি করে ঘটে থাকে নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও হয়রানি বাণিজ্য। প্রকৃতপক্ষে গণপরিবহনের চাহিদার বিপরীতে বিশাল ঘাটতি সামাল দিতে গিয়ে আমাদের সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতির নেতৃবৃন্দকে গলদঘর্ম হতে হয় বলে দাবি করেন তিনি। দেশের প্রায় প্রতিটি মহাসড়কে চলমান উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ, বিভিন্ন মহাসড়কে রাস্তার মাঝে প্রবল বর্ষণের কারণে সৃষ্ট গর্ত, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার, বিভিন্ন রোডের বিভিন্ন স্পটে রাস্তার ওপর বসা হাটবাজার, মহাসড়কে চলাচলকারী অটোরিক্সা, ব্যাটারি চালিত রিক্সাসহ অযান্ত্রিক যান এবারের ঈদযাত্রায় যানজটের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। এছাড়াও নৌপথে দুর্যোগপূর্ণ মৌসুম চলছে। তাই নৌপথে ওভারলোড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা না হলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ব্যাপক সম্ভাবনা বিরাজমান। এতে আলোচনা করেন গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপকমিটির সদস্য মহিউদ্দিন আহম্মেদ, সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সমন্বয়ক মোঃ সামসুদ্দীন চৌধুরী, লায়ন মাহমুদুল হাসান রাসেল, তৌহিদুল ইসলাম, আজহারুল আলম জিকু, জিয়াউল হক চৌধুরী, মিলাদ উদ্দিন মুন্না, আজিজুল হক চৌধুরীসহ ৪০ স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করে।
×