ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গী সংগঠনগুলো মাঠ পর্যায়ে মাথাচাড়া দিতে তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

জঙ্গী সংগঠনগুলো মাঠ পর্যায়ে মাথাচাড়া দিতে তৎপর

শংকর কুমার দে ॥ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের ব্যাপক সাফল্য সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে জঙ্গী আস্তানাগুলো। গ্রেফতার করা হচ্ছে নারী-পুরুষ জঙ্গী সদস্যদের। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ইভেন্ট ও মোবাইলে এ্যাপস খুলে চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গীদের সংগঠিত করার তৎপরতা। নেপথ্যে জঙ্গীদের মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষকতা কারা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গীরা নানাভাবে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। মাঠের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে এলেও ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গীরা এখনও সক্রিয়। এসব মাধ্যমে নানা গ্রুপ ও ইভেন্ট খুলে জঙ্গী তৎপরতা চালানো হচ্ছে। খুব সহজেই আকৃষ্ট করা হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের। এমনকি স্ত্রী জঙ্গী হওয়ার জন্য প্রভাবিত করছে স্বামীকে। আবার কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে স্বামী প্রভাবিত করছে স্ত্রীকে। জান্নাত লাভের জন্য শহীদি মৃত্যুবরণ করতে হিজরতে বের হওয়ার পর গ্রেফতার হয়েছে মিতু নামের সন্তানসহ এক নারী। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাব-১১-এর একটি দল দুই সঙ্গীসহ মিতু নামের এক গৃহবধূকে গ্রেফতার করেছে। ফেসবুকে ছয় মাস আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) এক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুর (১৯)। এরপর তিনি ধীরে ধীরে উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একই পথে আনার চেষ্টা করেন স্বামীকেও। ব্যর্থ হয়ে শিশুকন্যাসহ ‘হিজরতের’ নামে বাড়ি ছাড়েন মিতু। পরে তার বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে গত ১৭ এপ্রিল দুই সঙ্গীসহ মিতুকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১-এর একটি দল। মিতু সোনারগাঁয়ের প্রতাপের চর এলাকার নুরুল ইসলামের মেয়ে। তার স্বামীর নাম জুয়েল হোসেন। ২০১৭ সালে সোনারগাঁয়ের মেঘনা শিল্পনগরী স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে একই প্রতিষ্ঠানে এইচএসসিতে ভর্তি হন মিতু। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে মিতু গত ৩১ মার্চ দুই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। গত ২ এপ্রিল তার বাবা ও স্বামী এ খবর র‌্যাবকে জানান। মিতুর বাবা ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম র‌্যাবকে বলেছেন, মিতুর আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে ওই পথ (উগ্রবাদ) থেকে ফেরানোর জন্য চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি আইনের সহায়তার জন্য বিষয়টি র‌্যাবকে জানিয়েছি বলে জানান মিতুর বাবা নুরুল ইসলাম। র‌্যাব-১১-এর কার্যালয়ে গত ১৮ এপ্রিল এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর র‌্যাব নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। পরে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দায় অভিযান চালিয়ে দুই সহযোগীসহ মিতুকে আটক করে। এ সময় তার শিশু সন্তানকেও উদ্ধার করে। আটক অপর দুজন হলেন চট্টগ্রামের রাউজানের মেহেদি হাসান (২২) ও নোয়াখালীর হাতিয়ার আকবর হোসেন (৩০)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়াচ্ছে ॥ র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে মিতু বলেছেন, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ‘আল্লাহর সৈনিক’ নামে একটি ফেসবুক আইডির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ফেসবুকে জেএমবির সদস্য মেহেদি হাসানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর ধীরে ধীরে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে জেএমবিতে যোগ দেন মিতু। তিনি নিজেও ‘এসো ইসলামের পথে’ ও ‘আলোর পথ ইসলাম’ নামে দুটি ফেসবুক আইডি খোলেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্থিরচিত্র, ভিডিও চিত্রসহ উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। কাছের বন্ধুবান্ধবকেও উগ্র মতবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। মিতু তার স্বামীকেও উগ্রবাদের পথে আনার চেষ্টা করেন। এতে ব্যর্থ হয়ে মেহেদির পরামর্শে স্বামীকে ত্যাগ করে ‘শহীদি মৃত্যুবরণের’ লক্ষ্যে হিজরতের পরিকল্পনা করেন। মেহেদি তাকে বলেন, মাহরাম ছাড়া হিজরত করা যাবে না। মাহরাম হিসেবে বন্ধু আকবর হোসেনকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন মেহেদি। এরপর আকবরের সঙ্গে মিতুর যোগাযোগ করিয়ে দেন মেহেদি। আকবরকে মাহরাম হিসেবে পেতে মিতু তার স্বামীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৩১ মার্চ মিতু তার সোনারগাঁয়ের বাসা থেকে চট্টগ্রামে মেহেদি ও আকবরের কাছে চলে যান। মিতু জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, চট্টগ্রামে মেহেদি ও আকবর তাকে একটি ভাড়া বাসায় রেখে ‘শহীদ’ হতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও পরামর্শ দিতে থাকেন। এ সময় তারা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকার জেএমবির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্যে তারা নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দায় একত্র হয়েছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে আটক মেহেদির বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে। লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। তিনি ২০১১ সাল থেকে চট্টগ্রামের একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিক্রয় ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি ২০১৫ সালে জনৈক সামি ভাইয়ের মাধ্যমে হানাফি মাজহাব থেকে সালাফি মতাদর্শ গ্রহণ করেন। পরে জেএমবিতে যোগ দেন। তিনি ২০১৮ সালে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁয়ে গিয়ে বিভিন্ন গোপন বৈঠক করেছেন। নারীদের মাঝে পর্দার আড়ালে থেকে তিনি জেএমবির আদর্শিক বয়ান করেছেন। এর সুবাদে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় মিতুর সঙ্গে মেহেদির একাধিকবার দেখা হয়। আর আকবরের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। চট্টগ্রামের সাত তরুণ জঙ্গীর কথা ॥ চট্টগ্রামের আনন্দবাগে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তারা সবাই বয়সে তরুণ। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ওই তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মোবাইলের এ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে। গ্রেফতার হওয়া তরুণরা জিহাদের মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছিল। সমমনা জঙ্গীদের একত্র করতেও কাজ করছিল তারা। গ্রেফতার সাতজনের মধ্যে একজন কক্সবাজারে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেড ক্রসের ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত। একজন দেশের একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে, আরেকজন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বই ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে। জিহাদী ভিডিও ও ছবি প্রচার করে নিজেদের কথিত জিহাদের জন্য প্রস্তুত করছিল গ্রেফতারকৃত তরুণরা। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, র‌্যাবের অভিযানে জঙ্গী সন্দেহে সাত যুবককে গ্রেফতারের এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে জঙ্গীরা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। সরাসরি তৎপরতা বন্ধ করে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে। একই সঙ্গে স্পর্শকাতর জায়গাগুলো এখন তাদের টার্গেট। দেশের কক্সবাজার এলাকায় এখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে জঙ্গী প্রচারণা চালানো সহজ। অনেক আগেই এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রযুক্তিবিষয়ক সামর্থ্য আরও বাড়ানো দরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মোবাইল এ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গী তৎপরতা বন্ধে এটা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। একই সঙ্গে মাঠের জঙ্গীবিরোধী তৎপরতাও চালিয়ে যেতে হবে। জঙ্গী তৎপরতা বন্ধে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত তৎপরতা বৃদ্ধিরও কোন বিকল্প নেই বলে র‌্যাব কর্মকর্তার দাবি। রাজশাহীতে গ্রেফতার হওয়া পাঁচজনই কলেজ ছাত্রী ॥ রাজশাহীতে গ্রেফতার হওয়া সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই কলেজছাত্রী। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে গ্রেফতার সাত জঙ্গিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল তাদের গোদাগাড়ী থানায় হস্তান্তর করে মামলাটি দায়ের করেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউর রহমান। মামলায় সাতজনকে গ্রেফতার ও দুইজনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। সাতজনকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ছয়ঘাটি গ্রাম থেকে জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় একই পরিবারের সাতজনকে। এদের মধ্যে পাঁচজন কলেজছাত্রী। গ্রেফতারকৃতরা হলোÑ হাসান আলী (৪৩), তার স্ত্রী সেফালী খাতুন (৩৫), তাদের দুই মেয়ে ফারিহা খাতুন কনা (১৭) ও হানুফা খাতুন (১৯) এবং হাসান আলীর ভাতিজি মৃত রেজাউল করিমের মেয়ে ফারজানা আকতার সুইটি (১৭), রাজিয়া সুলতানা তিশা (২২) ও রোজিনা সুলতানা কলি (২৫)। রাজশাহী পুলিশ জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে হাসান আলী ও সেফালী খাতুন বেনিপুর জঙ্গী হামলার ঘটনার মামলার পলাতক আসামি। বেনিপুরের আস্তানায় জঙ্গী হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে তাদের নাম আসে। বেনিপুরের আস্তানায় আত্মসমর্পণ করা সুমাইয়া খাতুনের জবানবন্দীতে হাসান আলী ও সেফালী জেএমবির সঙ্গে জড়িত বলে জানানো হয়। এরপর থেকে পুলিশ তাদের খুঁজছিল। এরপর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাট থেকে ছয় নারীসহ সাতজনকে জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতার করেছে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে দুজন পুলিশের তালিকাভুক্ত জেএমবির সদস্য। বাকিরা নতুন সদস্য। নতুন করে সংগঠিত হচ্ছিল ওরা ॥ রবিবার দিবাগত রাতে র‌্যাবের একটি টিম রাজশাহীতে তিন জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে। রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ বানেশ্বর ও জামিরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- নগরীর বেলপুকুর থানাধীন পশ্চিম জামিরা এলাকার আবু বকর সিদ্দিকের ছেলে রাজু আহম্মেদ (২৪), জামিরা এলাকার আকতার আলীর ছেলে ফরহাদ হোসাইন (৩০), একই এলাকার আক্কাছ আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৩৬)।
×