ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ ও আইএস জঙ্গী হামলায় নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ

সাদ্দামের পতনের ১৫ বছর পরও ইরাকীদের স্বপ্ন বিবর্ণ

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৮ এপ্রিল ২০১৮

সাদ্দামের পতনের ১৫ বছর পরও ইরাকীদের স্বপ্ন বিবর্ণ

সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর কেটে গেছে, দীর্ঘ ১৫ বছর। বিবর্ণ হয়ে গেছে ইরাকীদের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশাগুলো। ১৫ বছর আগে মার্কিন সৈন্যরা যখন বাগদাদে প্রবেশ করে তখন তাদের দেখে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠেছিলেন ৬১ বছর বয়স পেরিয়ে আসা আবু আলী। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। সাদ্দাম মুক্ত ইরাকের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু এ বছরগুলো বয়ে এনেছে কেবল দুঃখ ও দুর্দশা। চলমান নৈরাজ্যে হামলায় নিহত তার ৩ ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর ইরাকে শুরু হয় সহিংসতা। গোষ্ঠীগত সংঘাত ও জিহাদী হামলায় পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিহত হয় হাজার হাজার মানুষ। আহত হয়েছে অজস্র ইরাকী। তারা সুস্থ হয়ে ওঠেনি আজও এবং দিন কাটাচ্ছে দুঃসহ অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে। ২০০৭ সালের জুলাইয়ে আবু আলীর বড় ছেলের বয়স ছিল ১৮ বছর। বাগদাদের পার্শ্ববর্তী কারাদা এলাকায় এক ব্যস্ত রাস্তায় গাড়িবোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ছেলেটি। সে তখন গ্রীষ্মের প্রচ- গরমে তরমুজ বিক্রি করছিল পথচারীদের কাছে। ৬ বছর পর ঠিক এমনি এক দিনে ট্যাক্সি ড্রাইভার আবু আলীর দুই ছোট ছেলে আলা (২৩) ও আব্বাস (১৭) নিহত হয় এক হামলায়। আবু আলীর জীবনে সন্তানদের হারানোর এ মর্মান্তিক বেদনা স্পষ্ট হয়ে রয়েছে তার মুখম-লের বলিরেখায়। আবু আলী স্বপ্ন দেখতেন তার চেয়ে সন্তানদের জীবন সুন্দর হয়ে ওঠবে। কিন্তু আজ তিনি কেবল দেখতে পান ছেলেদের কবরগুলো। তিনি বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে কবরগুলো দেখতে যাই। আমি গিয়ে বসি। অনুভব করি। ছেলেরা আমার পাশে বসে আছে। রাজধানী বাগদাদে নরসুন্দর ও কেশ বিন্যাসকারী কায়িস আল শারিয়া বলেন, সাদ্দামের প্রতিমূর্তি ভেঙ্গে ফেলার সঙ্গেই পতন হয়েছে বাগদাদের। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে সুদিনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলগুলো কেবল চায় আইন পরিষদে তাদের আসন। শারিয়া বলেন, সাদ্দাম ছিলেন লৌহমানব। তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন সবকিছু এবং তার রাসায়নিক অস্ত্রের প্রতি ভীতি ছিল সমগ্র বিশ্ব। বাগদাদের কেন্দ্রস্থলে আল ফেরদৌস স্কয়ারে তিনি তার সেলুনটি প্রতিদিন ভোরে যখন খুলতেন দেখতে পেতেন, স্কয়ারে একনায়কের বিশাল প্রতিমূর্তি যেন বাইরে প্রহরায় রয়েছে। তিনি বিশাল প্রতিমূর্তিটির প্ল্যাটফর্মের পাদদেশে দাঁড়িয়ে এএফপিকে বলেন, তার দোকানের সামনে ব্রোঞ্জের এ প্রতিমূর্তিটি যখন ভেঙ্গে ফেলা হলো তখনি পতন হলো বাগগাদের। প্ল্যাটফর্মটি এখন ইট পাথরের টুকরোয় আবৃত কিছুটা। শারিয়া (২৭) সে সময় সকল যুবকদের মতো ভেবেছেন যে, বাগদাদে অচিরেই নৈশক্লাব ও রেস্তরাঁয় ভরে যাবে। আমরা ভেবেছি, আমরা সমগ্র বিশ্ব ঘুরে বেড়াব। কিন্তু অগ্রগতি ও বিশ্বের কাছে আমরা উন্মুক্ত হওয়ার পরিবর্তে ইরাকীদের জীবনযাত্রা এমন হয়েছে যে, এক ধাপ অগ্রসর হলে পেছনে সরে যেতে হয়। পাঁচ ধাপ। ৬৫ বছর বয়স্ক কুর্দী রাজনীতিবিদ মাহমুদ ওসমানও স্বপ্ন দেখেছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। তিনি বলেন, আমেরিকানদের যদি সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পরিকল্পনাই ছিল তাহলে সাদ্দাম উত্তর কোন কর্মসূচী তাদের থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তা ছিল না। ওসমান সাদ্দামের পতনের পর ইরাকের অন্তর্বর্তী নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং ১৮ বছর বয়স থেকে কুর্দী পেশমের্গা যোদ্ধা ছিলেন। সাদ্দামের পতনের পর বিরোধী রাজনীতিবিদরা বাইরে নির্বাসন থেকে দেশে ফেরেন। ভেঙ্গে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ও সাদ্দামের সার্বিক ক্ষমতাধর বাথ পার্টি। দুর্নীতি ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বেড়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনী ভেঙ্গে দেয়ার কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা শূন্যতার মেধ্য গড়ে ওঠা মিলিশিয়া যে নৈরাজ্যকে আরও উস্কে দেয়। কুর্দী বিরোধী দল গোরানের নেতা রউফ মারুফ বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, আমরা একটি ফেডারেল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাচ্ছি। কিন্তু আমরা পেয়েছি গোষ্ঠীগত সংঘাত ও উৎকট স্বাদেশিকতা। ইরাকের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সদস্যরা বলেন, গত দেড় দশকের নৈরাজ্যের জন্য আমাদের সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে। ক্যালডিয়ান ক্যাথলিক যাজক লুই রাফায়েল সাকো বলেন, আমাদের দেশে দুর্যোগের পর দুর্যোগ বয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮ বছর বয়স্ক শিক্ষক আবদেল সালাম আল সামের বলেন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরাকে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা তেমনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সালাম দেখেছেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দেখেছেন মিলিশিয়াদের হাতে তার সহকর্মীদের নিহত হওয়ার দৃশ্য। -এএফপি
×