ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্রীহীন সুন্দরবন

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৮ মার্চ ২০১৮

শ্রীহীন সুন্দরবন

তাকে নিয়ে গাওয়া যেত হয়ত এক সময় ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গখানি তারায় তারায় খচিত। বর্ণে বর্ণে লোভন শোভন জানি স্বর্ণে স্বর্ণে রচিত।’ সৌন্দর্য তার ছিল ভরপুর। নাম তাই হয়েছিল সুন্দরবন। বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় অরণ্যের নাম সুন্দরবন। ভাল নেই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী। বৃক্ষ, তরুলতা, মৃত্তিকা, নদীর জল, মৎস্য, পাখিরা। সুন্দরবন থেকে অবাধে বাঘ ও হরিণ শিকার করছে চোরা শিকারি ও বনদস্যুরা। জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে ডলফিন, শুশুক, কুমিরের বাচ্চা ও বিরল প্রজাতির কচ্ছপ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের নানা অত্যাচারে কয়েক প্রজাতির প্রাণী এখন সঙ্কটাপন্ন। ইতোপূর্বে বন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গ-ার, মহিষসহ বেশকিছু প্রাণী। এক সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘ থাকলেও এখন তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে শুধু সুন্দরবনে। বাঘের সংখ্যা হবে শতাধিক। রয়েল বেঙ্গল টাইগার কেবলই শব্দ হিসেবে থেকে যাচ্ছে যেন। এই সংখ্যা হ্রাসের কারণ- এর চারপাশে মিল-কারখানা স্থাপন, বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল ও চোরা শিকারিদের কারণে বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। পাশাপাশি বিপন্ন হচ্ছে বনাঞ্চল, কোথাও নিশ্চিহ্ন প্রায়। দূষণ আর নাব্য কমে যাওয়ায় নদীগুলোতে আগের মতো ডলফিন দেখা যায় না। সুন্দরবনের নদীগুলোতে লবণ বৃদ্ধি, একই সঙ্গে প্রবাহিত নদী দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ ও কার্গো চলাচল এবং ওই যানের পাখার আঘাতে প্রায়ই বাচ্চা ও প্রাপ্ত বয়স্ক ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে। অন্য উভচর প্রাণীর আবাসও হুমকির মুখে। অজগর, নোনা পানির কুমির, ঘড়িয়াল, কাছিম, গোখরো সাপসহ অন্যান্য বিষধর সাপও বিপন্ন অথবা মহাবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। মূলত বন্যপ্রাণীগুলো বিলুপ্তি বা বিপন্ন হওয়ার নেপথ্যে মানুষ দ্বারা নির্যাতনের চিত্রটাই বেশি চোখে পড়ার মতো। নয়নাভিরাম সুন্দরবনের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি চার হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এবং জলাভূমি এক হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। এই বনভূমি ও জলাভূমিতে বাস করে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। প্রতিটি বাঘের চামড়া বিদেশে বিক্রি হয় কমপক্ষে দশ লাখ টাকায়, আর হরিণের চামড়া লাখখানেক টাকায়। অন্যান্য বন্যপ্রাণীও হচ্ছে শিকার। তবে বন বিভাগ মাঝে মধ্যে এসব চামড়া উদ্ধার করে থাকে। কিন্তু অপরাধী ধরা পড়ে না। সুন্দরবনের সব এলাকায় এখন কুমির নেই। বর্তমানে রয়েছে মাত্র এক শ’টি। জলবায়ু পরিবর্তন ও উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে ক্রমাগত বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ ও বিস্তৃতি। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কুমিরের প্রজননে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী। লবণাক্ততা সামান্য বাড়লে সুন্দরবনের নদী খালে পারশো, দাতিনা, টেংরা ও ভেটকি মাছ কমে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বন থেকে ইতোপূর্বে বিলুপ্ত হয়েছে গ-ার, বনমহিষ, মিঠা পানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ ও চার প্রজাতির পাখি। বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছ ও কাঁকড়ার ওপর। বিলুপ্ত হতে চলেছে ৯ প্রকার মাছ। সুন্দরবনের ভেতর প্রবাহিত নদীতে প্রাণীর দেখা মেলে কম। লবণাক্ততা তীব্র এখানে। লবণাক্ততার কারণে নদী ও খাল তীরবর্তী বৃক্ষ মরে যাচ্ছে। এমনিতেই অবাধে বনের গাছ কাটা হচ্ছে। যার ফলে বিপন্ন হচ্ছে অনেক বন্যপ্রাণী ও পাখিকুল। তাই সুন্দরবনের গাছে গাছে আগের মতো বানর ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায় না। কমে গেছে মৌচাকও। মৌয়ালিরা তাই পেশা বদলাচ্ছে। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে ১৩১ কিলোমিটার নদীপথে দেশী-বিদেশী জাহাজ চলাচল করছে। এসব জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন আতঙ্কিত করে তুলছে বন্যপ্রাণীদের। নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি। উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততার প্রাধান্য তীব্র। জলবায়ু পবির্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের মধ্যে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এই বৃদ্ধির হার বছরে তিন থেকে আট কিলোমিটার। এর ফলে জোয়ারের সময় বনভূমি ডুবে যাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। সে জন্য সঙ্কুুচিত হচ্ছে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র। বন্য ও জলজপ্রাণী রক্ষায় সুন্দরবনে কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ জরুরী। শ্রীহীন সুন্দরবনকে শ্রীময় করে তোলা জরুরী।
×