ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গোলটেবিলে কাজী রিয়াজুল হক

সংখ্যালঘুর ওপর হামলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

সংখ্যালঘুর ওপর হামলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভূমি সমস্যা দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এক পক্ষকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারলেই অন্যপক্ষ তা দখল নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। সকল হামলা ও নির্যাতনের মূলে ভূমি নিয়ে বিরোধ। সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান হামলা ও নির্যাতন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এজন্য প্রশাসনের একনিষ্ঠতা জরুরী বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। বৃহস্পতিবার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিশ^ মানবাধিকার বনাম বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক গোলটেবিল সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নারীর ওপর যে ধরনের নির্যাতন হচ্ছে সেসব বিষয় দেখলে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি চোখে পড়ে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার একদিন না এক দিন হবেই উল্লেখ করে তিনি পরিবর্তনের জন্য সবাইকে এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানান। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেল, এএলআরডি, আরবান, সিডিএ ও কাপেং ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন এবং পার্বত্য রাঙামাটি আসনের সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার। এআলোচকবৃন্দ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুশী কবির, চেয়ারপার্সন, এএলআরডি ও সমন্বয়কারী, নিজেরা করি; ড. আবুল বারকাত, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়; ড. স্বপন আদনান, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক; এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট প্রমুখ। বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০টির বেশি আদিবাসী গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত জনসংখ্যার ১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে আজো কোন সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এদের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ নানান পরিচয়ে পরিচিত করানো হয়েছে, তবে ‘আদিবাসী’ হিসেবে নয়। আদিবাসী মানুষের ভূমির অধিকার আজো নিশ্চিত নয়। তারাও সমতলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মতো নিরন্তর বঞ্চনা, বৈষম্যের শিকার। হরণ করা হয়েছে তাদের সাংবিধানিক অধিকার, ন্যায্য অধিকার, জন্মগত অধিকার, ঐতিহ্যগত অধিকার, প্রথাগত অধিকার ও গোষ্ঠীগত অধিকার। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজ থেকে দু’দশক আগে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অনেকটা থেমে আছে বলে গোলটেবিল সংলাপে উদ্বেগ প্রকাশ করেন আলোচকবৃন্দ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। সেই দেশে একটি গোষ্ঠী দেশের সম্পদ লুট করে বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করছে। সংবিধান রক্ষা করতে না পারলে দেশ প্রতিক্রিয়াশীলতার কানাগলিতে হারিয়ে যাবে। গোলটেবিল সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত। মূল প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের সংবিধানে বাংলাদেশ আছে পাকিস্তানও আছে, বঙ্গবন্ধু আছেন জিন্নাহ সাহেবও হারিয়ে যাননি। ধর্মের অপব্যবহার বা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বা তাদের সঙ্গে মেলবন্ধনে তৃণমূলে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাকে ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতি লুণ্ঠন ও জবরদখল প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখেছে। পাহাড়ী আদিবাসী মানুষ হারিয়েছে, হারাচ্ছে ভূমি-বনাঞ্চল যা তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ভিত্তি। ৫০ বছর আগে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৭৫ শতাংশ, আজ তা নেমে এসেছে ৪৭ শতাংশে; অর্থাৎ জনসংখ্যার দিক থেকে সেখানকার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সুদীর্ঘকাল পর সংশোধনী এলেও এ সংক্রান্ত বিধিমালা আজো প্রণয়নের উদ্যোগ না নেয়ায় ভূমিবিরোধ দু’দশক আগে যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। সমতলের আদিবাসীদের পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি আজো দাবি হিসেবেই আছে। জনসংখ্যা ব্যুরোর হিসাবানুযায়ী, বাংলাদেশে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বঙ্গবিভাগের সময় যেখানে পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর ৩১ দশমিক ২ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যা ৭০-এ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১১ সালের ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী তা ৯ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ’৪৭-র পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯৮ শতাংশের উপরের পাহাড়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর হার বর্তমানে ৪৭ শতাংশের নিচে অর্থাৎ তারা নিজ এলাকায় সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদসহ অন্যান্য অনুচ্ছেদে যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তবিক অর্থে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তার কোন বাস্তবানুগ প্রয়োগ নেই। রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্মকে সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়ে জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তাদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে, বৈষম্য, নিগ্রহ, নিপীড়ন কখনওা রাষ্ট্রীয়ভাবে, কখনও রাজনৈতিকভাবে, কখনও সামাজিকভাবে অব্যাহত ধারায় পরিচালনা করে তাদের ওপর ভয়ভীতির সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘সংখ্যালঘু মনস্তাত্ত্বিকতা’র দিকে ঠেলে দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির’ ঢেকুড় তোলা হয়েছে, হচ্ছে এবং নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি তৈরির পর ‘নিরাপত্তা বলয়’ তৈরির নামে প্রতারণা চলছে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির উত্তরণ আজো হয়নি। লক্ষ্যনীয় ১৯৯০, ১৯৯২, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যলঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে যে সহিংসতা চালানো হয়েছে আশা করা হয়েছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী সরকারের আমলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একই রকমের ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে। ঘটছে একনাগারে ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে। প্রথমদিকে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত, স্কুল শিক্ষকদের টার্গেট করে, মহানবীকে (স:) কটূক্তির মিথ্যা অভিযোগে, পরবর্তীতে ফেসবুকে ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষের অভিযোগে। হুমকি, হামলা, জমি দখল নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ, পাবনার সাঁথিয়া, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রাঙামাটির লংগুদু হয়ে সম্প্রতি রংপুরের ঠাকুরপল্লী হামলার ভয়াবহতাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এএলআরডির চেয়ারপার্সন খুশী কবির বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্নস্থানে ঘটে যাওয়া হামলা, উচ্ছেদ ও নির্যাতনের ঘটনার বিশ্লেষণে নিপীড়কের ভূমিকায় রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ও তাদের অনুসারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। অন্যদিকে সরকারী প্রশাসনের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা হামলা ও উচ্ছেদের কোন কোন ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছেন।
×