ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. রেবা মন্ডল

আন্তর্জাতিক আইনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়

প্রকাশিত: ০২:২৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

আন্তর্জাতিক আইনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়

আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম প্রসিদ্ধ দলিল ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (UDHR) প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে, প্রত্যেকের রয়েছে সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা। আর যখনই কোথাও মানুষের অধিকার কিংবা মানবিক মর্যাদা লঙ্ঘিত হয়, অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন হয় কিংবা বৈষম্য সৃষ্টি হয় তখনই অবহেলিত ও নির্যাতন-বৈষম্যের শিকার মানুষ অন্যায়-অত্যাচার-খুন-রাহাজানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রত্যাশা করে, আন্দোলন-সংগ্রাম করে, পৃথকভাবে বসবাস ও জীবনযাপন করতে চায় এবং নিজেরাই নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার বাসনায় উজ্জীবিত হয়। এভাবেই মানবগোষ্ঠী যুগে যুগে স্বাধীন-মুক্ত-উন্নত ও শান্তিময় জীবনের আকাক্সক্ষায় যুদ্ধ করে হলেও মুক্ত হয়েছে। তাই তো আমাদের বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ‘... এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু পশ্চিম-পাকিস্তানী, বৈষম্যকারী, নিগ্রহকারী খুনী শাসকচক্রের শোষণ থেকে পূর্ব বাংলার জনগণকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এবং বোবা-কানা সকল মানুষের হৃদয়ের কথা, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের কথা নিজের অন্তরে ধারণ ও লালন করে মুক্ত বাংলা তথা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়তে পেরেছিলেন। তাই তো ত্রিশ লাখ শহীদ নারী-পুরুষ ও আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আত্মার স্বপ্নের স্বাধীন দেশ আজ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। কোন জাতিই আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার চর্চা ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধে কিংবা মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত হতে পারে না এবং স্বাধীন-সার্বভৌম-মুক্ত দেশ বা জাতি গঠন করতে পারে না। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বলতে জনগণের এমন এক অধিকার বোঝায় যার মাধ্যমে জনগণ তাদের ইচ্ছেমতো দেশ চালাতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে অথবা নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যও নিজেরা নিজেদের সরকার দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ার জন্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গঠন করতে পারে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ৮ জানুয়ারি ১৯১৮ তার আমেরিকান কংগ্রেসে দেয়া চৌদ্দ দফা বক্তব্যের এক মাস পর প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন : ÒNationalist aspirations must be respected; peoples may nwo be dominated and governed only by their own consent. ÔSelf determinationÕ is not a mere phrase. It is an imperative principle of action which statesmen will henceforth ignore at their peril. ’’ আটলান্টিক চার্টারে রুজভেল্ট ও চার্চিল এ রকমই মত পোষণ করেন। ১৯৪৫ সালের টঘ ঈযধৎঃবৎ-এ আত্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়টি দুবার উল্লিখিত হয়েছে। ১৯৬০ সালের Declaration on the Granting of Independence to Colonial Countries and Peoples (DGICCP) বা ‘কলোনি স্বাধীনতা ঘোষণাটি’ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রথম আন্তর্জাতিক দলিল। টঘঊঝঈঙ-র ১৯৯০ সালের Meeting of Experts on Further Study of the Rights of Peoples, Paris ১৯৯০ অনুযায়ী তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বৈধ জনগোষ্ঠী ছিল। তদুপরি International Covenant on Civil and Political Rights, ১৯৬৬ ও International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights, ১৯৬৬-এর প্রথম অনুচ্ছেদ মোতাবেকও তারা এ অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বৈধ জনগোষ্ঠী ছিল। উপরন্তু পূর্ব-পাকিস্তানীরা তথা বাঙালীরা ছিল সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। African Charter on Human and PeopleÕs Rights-এ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে এভাবে : the right of coloni“ed or oppressed peoples to be free from the bond of domination [Article 20(2)]| পূর্ব-পাকিস্তানীরা তথা বাঙালীরা একদিকে যেমন ছিল কার্যত (ফব ভধপঃড়) কলোনিবাদের শিকার তেমনি অন্যদিকে ছিল নির্যাতিত যার দরুন প্রমাণিত হয় যে, তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে বৈধ ছিল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নির্যাতনের ইতিহাস। তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ছিল ৫৬%। উর্দুভাষী ছিল মাত্র ৭%। অথচ পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা ছিল : উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এ ঘোষণা ছিল Majority must be granted-এ নীতির পরিপন্থী অর্থাৎ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ভাষা মানেই সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ যার মাধ্যমে একটি জাতির পুরো অবয়ব ফুটে ওঠে। এই ভাষা চর্চায় বাধা প্রদান ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (টউঐজ) ১৫ ও ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩০৯টির মধ্যে ৩০০টি) পাওয়া সত্ত্বেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জারিকৃত সামরিক শাসন গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামক অদ্ভুত এক নির্বাচন পদ্ধতির (বিডি-রা বাবেসিক ডেমোক্র্যাটরা তথা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যানরা সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার হবে, অন্য কেউ নয়) মাধ্যমে জনগণের সরাসরি ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেয়। এর মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা তথা মানবিক যুক্তি প্রদান ও কল্পনা করার শক্তি বিনষ্ট করে দেয়া হয় যাতে করে আইনস্টাইনের এই উক্তিকে অগ্রাহ্য করা হয় : ‘Logic will take you from ÔAÕ to ÔBÕ, imagination will take you everywhere.’ বাস্তবিক অর্থে মানুষের কল্পনা শক্তিকে বাধা প্রদান করলে মানুষ শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ না হলেও মানসিক বিকলাঙ্গতায় ভোগে, যার মাধ্যমে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে চিরতরে প্রকৃত অর্থে বিকলাঙ্গ ও ধ্বংস করা সম্ভব। বাঙালীদেরও একইভাবে বিকলাঙ্গ করার চেষ্টা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাক-সরকার কেবল মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের বর্ডারে সৈন্য মোতায়েন করে অথচ পূর্ব-পাকিস্তান বর্ডার সম্পূর্ণরূপে সৈন্যবিহীন অরক্ষিত রাখে। এর মাধ্যমে সরকার বাঙালীদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। পূর্ব-পাকিস্তানীরা তথা বাঙালীরা একই রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের মাথাপিছু আয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় কম। ১৯৬৯ সালে বাঙালীদের ১৪২ টাকা ধরলে পশ্চিমীদের ২২৩ টাকা। সরকারী চাকরিতে বাঙালীদের প্রাধান্য কোথাও ছিল না। প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে বাঙালীর চাকরি ছিল মাত্র ১৯%, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৮.১%, শিক্ষায় ২২.৫%, শিল্পে ৪৫.৭%, তথ্যে ২৭.৩%, স্বাস্থ্যে ১৯%, কৃষিতে ২১% এবং আইনে ৩৫%। এ রকম বিরামহীন নির্যাতন ও বৈষম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়-শোষিত-বঞ্চিত মানুষের নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে ও শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে ছয়-দফা দাবি উত্থাপন করলে তিনিসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগে পাকী সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হয় সত্তরের নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন তথা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেলেও পাকী শাসকরা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি, বরং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে অর্থাৎ গভীর রাতে ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র-ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর বোম্বিং ও গণহত্যা শুরু করে। মানুষ, দেশ ও জাতিকে রক্ষা ও মুক্ত করার অন্য কোন উপায় না দেখে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ও অবিসংবাদিত নেতা, গণমানুষের মুক্তির অগ্রদূত বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বীর বাঙালী যার যা ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, লড়াই করে দীর্ঘ নয় মাস এবং এক নদী রক্তের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকস্তানী নরপিশাচদের পরাভূত করে ছিনিয়ে আনে বিজয়ের রক্তিম সূর্য। উপরের আলোচনা থেকে বোঝা কঠিন নয় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জন আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত ও সিদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত বৈষম্য-নির্যাতন-ধর্ষণ-গণহত্যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দলিল অনুযায়ী নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মানবাধিকার দলিল (টউঐজ)-এ পাকিস্তান স্বাক্ষর (ংরমহধঃঁৎব) দিয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭, ১৯৬৬ সালের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ওঈঊঝঈজ)-এ রেটিফিকেশন দিয়েছে ১৭ এপ্রিল ২০০৪, ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ওঈঈচজ)-এ রেটিফিকেশন দিয়েছে ২৩ জুন ২০১০, ১৯৭৯ সালের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ চুক্তি (ঈঊউঅড)-তে রেটিফিকেশন দিয়েছে ১৯৯৬ সালে, UN Convention Against Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment (UNCAT)-এ রেটিফিকেশন দিয়েছে ২৩ জুন ২০১০, এবং Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide, ১৯৪৮-এ রেটিফিকেশন দিয়েছে ১২ অক্টাবর ১৯৫৭। অথচ আশ্চর্যের বিষয় পাকিস্তান এখন পর্যন্ত তার কৃত অপকর্ম ও অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। বরং সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের জনগণ ও সার্বভৌমত্ববিরোধী মন্তব্য ও বক্তব্য দিতে পিছপা হয় না। আজকে আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয় অর্জন, ১৬ ডিসেম্বর ও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ কোনটাই সম্ভব হতো না জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে। পাশাপাশি আমাদের জাতীয় অগ্রগতি, উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, পুরস্কার, সুনাম, বিজয় অর্জন এসবের কোন কিছুই অর্থবহ হতো না, চলমান থাকত না, যদি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো মানবতাবাদী ও উদার গণতান্ত্রিক, সৎ-যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে নিরন্তর সম্পাদন না করতেন। আন্তরিক ধন্যবাদ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। লেখক : অধ্যাপক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
×