ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

নক্ষত্রলোকের আগন্তুক

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

নক্ষত্রলোকের আগন্তুক

আজ থেকে অনেক অনেক দিন আগে যখন পৃথিবীর জন্ম হয়নি সে সময় আমাদের নীহারিকা মিলকি ওয়ের কোন এক জায়গায় একটি নক্ষত্রকে ঘুরপাক খেয়ে চলা বড়সড় একটা পাথরের পি- প্রচণ্ড বেগে আপন কক্ষপথ থেকে ছিটকে গিয়েছিল। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটেছিল যে, যে নক্ষত্র থেকে এর জন্ম সেই নক্ষত্রের পরিম-লের একদম বাইরে চলে এসেছিল এটি। তারপর মহাশূন্যের পথ পরিক্রমা দিতে দিতে সেই গ্রহাণুটি আমাদের এই সৌরজগতের ভেতরেও চলে আসে এবং তারপর সেখান থেকে বেরিয়েও গেছে। এই চলে আসা ও চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটেছে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মধ্যে। আর পৃথিবী থেকে সেই বস্তুটির সন্ধান বের করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গত ১৯ অক্টোবর তারিখে। সৌরজগতের বাইরের কোন আগন্তুক এই প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ল। গ্রহাণুটি যে আমাদের এই সৌরজগতের নয় বরং এর বাইরের সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন কিভাবে? হলেন এর গতি দেখে। প্রতি সেকেন্ডে ওটি সাড়ে ২৫ কিলোমিটার পথ ছুটে চলেছিল। এত দ্রুতগতিতে ছুটে চলা কোন বস্তুর সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আবদ্ধ হয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর এর এই প্রচ- গতিটা কোন গ্রহের কাছাকাছি হওয়ার কারণে সেটি থেকে বাড়তি মহাকর্ষীয় লাথি খাওয়ার জন্য হয়েছে তাও নয়। কারণ গ্রহাণুটি এসেছে সৌর অয়নবৃত্তের (একলিপটিকাল প্লেন) যথেষ্ট উপরে থেকে। বলাবাহুল্য এই সৌর অয়নবৃত্তের কাছাকাছিই সূর্যের সকল গ্রহ কক্ষ প্রদক্ষিণ করে থাকে। হাওয়াই ভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী রব ওয়েরিক প্রথম গ্রহাণুটি আবিষ্কার করেন। তিনি বলেছেন, এটি যে সৌরজগতের বাইরের কোন নক্ষত্রলোক থেকে আসা সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অন্যান্য টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ থেকেও গ্রহাণুটির আগমন বাইরে থেকে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গ্রহাণুর নাম দেয়া হয়েছে এ/২০১৭ ইউ১। সূর্যকে অতিক্রম করে এসে গ্রহাণুটি গত ১৪ অক্টোবর পৃথিবীর প্রায় আড়াই কোটি কিলোমিটার নিচ দিয়ে চলে গিয়ে আবার দ্রুতগতি সৌর অয়নবৃত্তের ওপরে ওঠে গেছে। এখন এটি সৌরজগত ছেড়ে পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে প্রতি সেকেন্ডে ৪৪ কিলোমিটার গতিতে ধাবিত হচ্ছে। পাথুরে এই গ্রহাণুটি প্রায় ৪শ’ মিটার চওড়া। গ্রহ গঠনের যেসব মডেল আছে তদনুযায়ী এ/২০১৭ ইউ১ এর মতো ভিন্ন নক্ষত্রলোকের এই বস্তুটির গ্রহাণুর মতো শুকনো পাথুরে পি- হওয়ার চেয়ে বরফ জমাট ধূমকেতু হওয়ারই কথা যেগুলোর জন্ম সৌরজগতগুলোর প্রান্তভাগে। তাহলে জনক নক্ষত্রগুলোর তাপপ্রবাহে সেগুলো ওখান থেকে বিতাড়িত হয়ে যাবে। বস্তুতপক্ষে এ/২০১৭ ইউ১ বস্তুটিকে প্রথমে ধূমকেতু শ্রেণীতে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সূর্যের কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ধূমকেতুর গ্যাস ও ধূলিকণার যে পুচ্ছ তৈরি হয় এক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং এর গাত্র থেকে প্রতিফলিত সূর্যালোক বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মনে হয়েছে এর পৃষ্ঠদেশ মূলত পাথরে গঠিত। একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে ধূমকেতুর যে উদ্বায়ু রাসায়নিক পদার্থগুলো থেকে পুচ্ছ তৈরি হবার কথা কোটি কোটি বছরের মহাশূন্য পরিক্রমার সময় মহাজাগতিক রশ্মীর প্রভাবে সেগুলো অধিকতর জমাট যৌগে পরিণত হয়েছে। আরেক ব্যাখ্যা হলো, আমাদের সূর্যই যে প্রথম নক্ষত্র যার কাছ দিয়ে ধূমকেতুটি উড়ে গেছে তা হয়ত নয়। আগেও অন্য কোন নক্ষত্রের পাশ দিয়ে এটি হয়ত উড়ে গিয়েছিল এবং সেটির উত্তাপে ধূমকেতুর উদ্বায়ু পদার্থগুলো উবে গিয়ে থাকতে পারে। এমনও হতে পারে যে বস্তুটি শুরুতেই ছিল শুষ্ক। যাই হোক, গ্রহাণুটি সৌর অয়নবৃত্তের প্রায় সরাসরি ওপর থেকে আমাদের সৌরজগতের দিকে এগিয়ে আসে। গত ২ সেপ্টেম্বর এটি সৌরজগতে প্রবেশ করে এবং ৯ সেপ্টেম্বর সূর্যের নিকটতম স্থানে পৌঁছে। এরপর ১৪ অক্টোবর এটি পৃথিবীর কক্ষপথের নিচ দিয়ে যায়। পৃথিবী থেকে যতদূর দিয়ে যায় সেটা পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্বের প্রায় ৬০ গুণ। গ্রহাণুটি এসেছে লিয়া নক্ষত্রপুঞ্জের দিক থেকে এবং এখন যাচ্ছে পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট ও অন্যান্য
×