ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পোপ আজ আসছেন ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটকেই বাংলাদেশের প্রাধান্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

পোপ আজ আসছেন ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটকেই বাংলাদেশের প্রাধান্য

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা নিয়ে তিন দিনের সফরে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসছেন খ্রীস্টান রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। ভ্যাটিকানের প্রভাবশালী এই ধর্মগুরুর ঢাকা সফরে রোহিঙ্গা সঙ্কটকেই প্রাধান্য দেবে সরকার। এছাড়া তার ঢাকা সফরকালে রোহিঙ্গাদের একটি ছোট গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টিই সবার নজরে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ফ্রান্সিস পোপ ঢাকায় আসছেন। ৩১ বছরের মধ্যে কোন পোপের এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। পোপকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হবে। মিয়ানমারে তিন দিনের সফর শেষ করে ইয়াঙ্গুন থেকে সরাসরি একটি বিশেষ বিমানে আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছবেন। মিয়ানমারের উদ্দেশে রোম ত্যাগের আগে দেয়া এক বার্তায় পোপ বলেছেন, বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতিলগ্নে আমি দেশটির গোটা জনগোষ্ঠীকে শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের বার্তা দিতে চাই। আমি এমন একটি মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছি যখন আমরা সবাই একত্রিত হব। ভ্যাটিকানের পোপ ফ্রান্সিস এমন এক সময় ঢাকায় আসছেন, যে সময় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলা করছে। এছাড়া পোপ ফ্রান্সিস প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকেই বাংলাদেশে আসছেন। সে কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পোপের সফরের সময় রোহিঙ্গা সঙ্কটকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়েই পোপকে ঢাকার বার্তা দেয়া হবে বলে জানা গেছে। এদিকে ঢাকার রমনা ক্যাথেড্রাল থেকে জানানো হয়েছে, পোপের সফরের প্রতিপাদ্য হলো শান্তি ও সম্প্রীতি। সরকারের অনুমোদন নিয়ে আয়োজকরা রোহিঙ্গাদের একটি ছোট গ্রুপকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে প্রায় দুই বছর ধরে পোপের বাংলাদেশ সফর নিয়ে আলোচনা চলছিল। পোপও বাংলাদেশে আসার সুবিধাজনক সময় খুঁজছিলেন। অবশেষে নবেম্বরে তার সফরসূচী নির্ধারিত হয়। সে অনুযায়ী ৩০ নবেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর করবেন। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও উদার বহুত্ববাদী বৈশিষ্ট্য পোপকে বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী করে তুলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ ক্যাথলিক খ্রীস্টান বাস করছে এবং একজন কার্ডিনাল রয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত ভ্যাটিক্যান রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ জর্জ কোচেরি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পোপের বহুল প্রত্যাশিত সফরটি শুরু হতে চলেছে। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণের পর আমরা অনেকদিন ধরে সফরটি চূড়ান্ত করতে কাজ করেছি। কারণ, ১৯৮৬ সালের ১৯ নবেম্বর পোপ জন পল দ্বিতীয়ের পর এই প্রথম আরেক জন পোপ আসছেন। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন আর ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য দেখতে আগ্রহী। ঋতুর বৈচিত্র্য বিবেচনায় সবচেয়ে অনুকূল সময় হিসেবে নবেম্বরের শেষ সময়কেই বেছে নেয়া হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পোপ নির্বাচিত হন। তিনি বিশ্বের ২৬৬ তম পোপ। বর্তমান পোপ ফ্রান্সিসের প্রধান কার্যালয় রোম শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ভ্যাটিকান সিটি। রোমের বিশপ হিসেবে, তিনি বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চ এবং সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটি উভয়েরই প্রধান। পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের প্রায় ১৩০ কোটি ক্যাথলিক খ্রীস্টানের প্রধান ধর্মগুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে। ১৯ বছর বয়সে যাজক হওয়ার ইচ্ছায় ইম্মাকুলাডা সেমিনারিতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ক্যাথলিক পুরোহিত হিসেবে তার অভিষেক হয় ১৯৬৯ সালে। বুয়েনস আয়ার্সে আর্চবিশপ হন ১৯৯৮ সালে। পোপ জন পল দ্বিতীয় তাকে ২০০১ সালে কার্ডিনাল করেন। কার্ডিনাল হওয়ার মাধ্যমে তিনি ক্যাথলিক ধর্মসঙ্ঘে পোপের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকারী হন। তিনি ২০১৩ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের স্থলাভিষিক্ত হন। পোপ হওয়ার পর তিনি তার বিনয়ী ভাবমূর্তির জন্য সারা বিশ্বের নজর কেড়েছেন। তিনি দায়িত্বহীন উন্নয়নের যেমন বিরোধিতা করে আসছেন তেমনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপেও সমর্থন যুগিয়েছেন। আন্তর্জাতিক কূটনীতির অংশ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করেছেন। একই সঙ্গে অভিবাসন সঙ্কট নিয়েও সোচ্চার তিনি। পোপ ফ্রান্সিস গত বছর অক্টোবরে নতুন ১৭ ধর্মযাজককে কার্ডিনাল মনোনীত করেন যার মধ্যে বাংলাদেশের আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম কার্ডিনাল হন। অর্থাৎ পরবর্তী পোপ নির্বাচনে একজন বাংলাদেশীও ভোট দেবেন। এই কার্ডিনালদের মধ্য থেকেই পরবর্তী পোপ নির্বাচিত হবেন। সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে পোপ ষষ্ঠ পল ঢাকায় এসেছিলেন। সে বছর ২৭ নবেম্বর অনানুষ্ঠানিকভাবে মাত্র এক ঘণ্টার যাত্রাবিরতিতে বিমানবন্দরে অবস্থান করেছিলেন ষষ্ঠ পল। যাত্রা বিরতির সময়ে বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮৬ সালে ঢাকায় আসেন দ্বিতীয় পোপ জন পল। এরপর এবার ঢাকায় আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। পোপের সফরসূচী ॥ পোপ ফ্রান্সিস তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। প্রথম দিন বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় ঢাকায় পৌঁছবেন পোপ। বেলা চারটায় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। একই দিনে তিনি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। বিকেল ৫টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে পোপ বৈঠক করবেন। বঙ্গভবনে সরকার, নাগরিক সমাজ, কূটনীতিকদের উদ্দেশে তিনি বক্তৃতা করবেন। আগামীকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রিস্টধর্মীয় উপাসনা ও যাজক অভিষেক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন পোপ। বেলা ৩ টা ২০ মিনিটে পোপের সঙ্গে দেখা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টায় আর্চবিশপ হাউজের মাঠে এক প্রার্থনায় যোগ দেবেন। শনিবার সকাল দশটায় তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা হাউস পরিদর্শন করবেন। এরপর তেজগাঁও কবরস্থান ও পুরাতন গির্জা পরিদর্শন করবেন। বেলা তিনটায় নটর ডেম কলেজে তরুণ সমাজের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। শনিবার বিকেল পাঁচটায় পোপ রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
×