ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সন্তানদের মানসিক বিকাশে...

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

সন্তানদের মানসিক বিকাশে...

মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক সকল প্রকার সম্পর্ক থেকে মধুরতম। নানাভাবে তা ব্যাখ্যা করা যায়। সময়ের পরির্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের বিস্তারও একটি নানামুখী ক্যানভাস। মাতা-পিতার অপরিসীম আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে এক নবজাতক আলোর মুখ দেখে। প্রতিনিয়ত পরিচর্যায় নবজাতক ক্রমশ শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনে উপনীত হয়। প্রযুক্তির বিকাশের পূর্বে মানুষে মানুষে এক রকম সহজ সম্পর্ক ছিল, যা মানুষের জন্য এতটা আত্মবিনাশী হয়ে দাঁড়ায়নি অথচ কালান্তরে সম্পর্কের বিষয়টি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করেছে। একুশ শতকে সন্তানের সঙ্গে মাতা-পিতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নানাবিধ জটিল প্রসঙ্গ উঠে আসে। সন্তানের ভেতর মাতা-পিতার মনো দৈহিক প্রকৃতিগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। প্রথমেই শিশু তার মাতা-পিতাকেই অনুকরণ করে। নাগরিক সমাজে পেশাগত কারণে মাতা-পিতার সঙ্গে নিবিড় সঙ্গ লাভের সুযোগ থাকে না। তারা বেড়ে উঠছে পরিচারিকা কিংবা দূর সম্পর্কিত আত্মীয়ের কাছে। যা শিশু মনে এক গভীর নিঃসঙ্গতার অনুভূতির জন্ম দেয়। নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য এ সব শিশুকে বাধ্য হয়ে যন্ত্রের শরণাপন্ন হতে হয়। টেলিভিশন, কম্পিউটারে কার্টুন কিংবা গেমসে দিব্যি শিশুদের সময় কেটে যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে শিশুর জন্য এ এক বিনোদন অথচ তাকে কিছুতেই বিনোদন বলা যায় না। একটু ভেবে দেখলেই স্পষ্ট হবে শিশু মনের ওপর কার্টুন কিংবা ভিডিও গেমসের প্রভাব কতটা মারাত্মক ফল বয়ে আনতে পারে। অতিরিক্ত কার্টুন কিংবা ভিডিও গেমসের প্রতি আসক্তির ফলে কখনও কখনও শিশুরা কার্টুন কিংবা নাটকের চরিত্রের মতো আচরণ করতে থাকে। আবার কৈশোরে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অতিমাত্রায় নাটক কিংবা সিনেমাপ্রীতি লক্ষ্য করা যায়। তার পরিণতিতে কেউ কেউ ড্রামাটিক সিনড্রোম নামে এক প্রকার মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এটি এমন একটি মানসিক রোগ যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে জীবনের প্রতিটি ঘটনাকে যেন একটি নাটকের দৃশ্য বলে মনে হয়। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে শিশুরাও এখন অবাধ বিচরণ করছে ইন্টারনেটে। ইন্টারনেটে নিয়ন্ত্রণবিহীন এ অবাধ বিচরণ ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই মাতা-পিতার নজরদারি থাকা উচিত। মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে আছে পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য। জগতের সকল সমাজে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্যের পালা বদল লক্ষ্য করা যায়। মতের মিল কিংবা অমিল প্রতিটি সম্পর্ক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গল্প-নাটক-চলচ্চিত্র কিংবা বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার সম্পর্কের টানাপোড়েন এক নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পারিবারিক প্রেক্ষাপটে জটিলতর সমস্যারও সহজ সমাধান বেরিয়ে আসে। বিবাহ বিচ্ছেদ একটি ঘাতক ব্যাধি। তার বড় শিকার শিশু ও কিশোররা। সমাজে এর কুফল দীর্ঘমেয়াদী। আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ এখন একটি সাধারণ ঘটনা। এ ছাড়া যে সব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বৈরী সম্পর্ক বিরাজমান সে পরিবারের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তবে পিতা-মাতার অসুখি দাম্পত্য জীবন সন্তানদের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের থেকে অধিকতর শ্রেয়। যেহেতু মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানের জীবন একই সুতায় গাঁথা, তাই একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন সন্তানের অধিকার। চাঞ্চল্য, স্নেহের স্পর্শ, প্রিয়জন সান্নিধ্য ও প্রকৃতিলগ্নতা এই চারটি বিষয় শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকৃতির ভেতর শিশুকে মুক্ত করে দিলে তার দেহ মন পূর্ণরূপে বিকশিত হবে। শারীরিক বিকাশের লক্ষ্যে শিশু-কিশোরদের জন্য নিয়মিত শরীরচর্চার অবকাশ রাখতে পারলে তাদের সমূহ মঙ্গল। একটি কিংবদন্তিতুল্য বাক্য আছে, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’। নানা ব্যস্ততার ভেতরেও পিতা-মাতার বিচক্ষণ সিদ্ধান্তসমূহ সন্তানের ভবিষ্যত জীবনের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। স্নেহ ও শাসনের পরিমিত প্রয়োগ সন্তানকে অপরাধ প্রবণতা থেকে বিরত রাখে।
×