ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

বিদ্যুতের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করা উচিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

বিদ্যুতের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করা উচিত

রশিদ মামুন ॥ বিদ্যুতের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ^বাজরে জ্বালানির নিম্নমুখী দরের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। শুধু বিদ্যুত বাবদই নয় অতিরিক্ত ব্যয় হবে কৃষি এবং শিল্পের উৎপাদনে। এতে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে নতুন করে জীবন ধারণের ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কায় রয়েছে সাধারণ মানুষ। এবার বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলোর বিতরণ খরচকে বিবেচনা করা হয়েছে। পাইকারি দর ঠিক থাকলেও কেন বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হলো তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অতীতে পাইকারি ঠিক রেখে খুচরা দাম বৃদ্ধির নজির খুব একটা নেই। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে কোম্পানিগুলোর তহবিলে জমা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শিল্প এবং কৃষি এবং বাণিজ্যিক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার দর কি পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে কমিশনের সে বিষয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কষ্টের চেয়ে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থই বড় করে দেখে থাকে রেগুলেটরি কমিশন। পাইকারি দর কমানোর ক্ষেত্রে ভোক্তাদের যে দাবি ছিল তা আমলেই নেয়নি বিইআরসি। তেলের মূল্য সমন্বয় এবং ব্যয়বহুল বিদ্যুত কেন্দ্র কম চালিয়ে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করলে উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হতো। এতে বিতরণ কোম্পনির বিদ্যুতের দাম কমানো যেত। কমিশন সেই পথে না হেঁটে সরাসরি বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। কমিশন সূত্র বলছে, পাইকারি মোট দাম ঠিক রেখে বিতরণ কোম্পানির জন্য বিদ্যুতের দর পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এবার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য কমানো হয়েছে। আরইবির চার টাকা ২৩ পয়সার দাম ইউনিটে ১৭ পয়সা কমিয়ে ৪ টাকা ০৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নেসকোর দাম ৬২ পয়সা কমিয়ে ৫ টাকা ১২ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৪৯৮ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠান দুটির একদিকে বিদ্যুত কিনে লাভ করবে অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় গ্রাহকের কাছ থেকেও তারা লাভ করবে। জানা গেছে, সাধারণত বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইউনিট প্রতি ব্যয় হয় ১৫ থেকে ২০ পয়সা কিন্তু আরইবির ক্ষেত্রে এই ব্যয় ৬৫ পয়সা। সারাদেশে বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণ করণেই অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। আর সেই ব্যয় দাম বাড়িয়ে চাপানো হচ্ছে গ্রাহকের কাঁধে। নতুন গ্রাহককে বিদ্যুতায়নের খরচ অন্যগ্রাহকের কাছ থেকে তুলে নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার তার ভিশন বাস্তবায়নে বিকল্প পন্থায় অর্থায়ন না করে ভোক্তাদের কাছ থেকে তুলে নেয়ার সমালোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া নতুন কোম্পানি গঠনের পর নেসকো সরকারী থেকে কোম্পানি স্কেলে বেতন নেয়াতে আরও ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। এর দায়ও গ্রাহকের ওপর চাপানো হয়েছে। আর এতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, উল্লেখ করে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী এবং বিদ্যুত সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যাশা ছিল আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের এই যৌক্তিক দাবি প্রধানন্ত্রীর সামনে উপস্থাপিত হয়নি। এর বদলে একটি সিন্ডিকেট প্রচার করেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই দাম বাড়ানো হয়েছে বিষয়টি এমন ইঙ্গিত বহন করে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি সরকারকে বিব্রত করতে ভুল বুঝিয়ে একটি সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়েছে। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বিইআরসিতে ডিসপিউট সেটেলমেন্ট ট্রাইবুনালে আমরা আবেদন জমা দেব। এরপর তারা আবেদনের সুরাহা না করলে আমরা আদালতে যাব। উল্লেখ্য, এর আগে গত জানুয়ারিতে দুই ধাপে গ্যাসের দর বৃদ্ধির বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আদালত এই দাম বৃদ্ধির একটি ধাপকে আটকে দেয়। গত বোরো মৌসুমে ফলন কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। এবার ঠিক বোরো মৌসুম শুরু আগে সেচের খরচ বাড়িয়ে দেয়া সুবিবেচনা প্রসূত হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে। আগে সেচে প্রতি উইনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ৩ টাকা ৮০ পয়সা আর এখন সেই দাম ৪ টাকা করা হয়েছে। এবার তৃণমূলের অর্থাৎ লাইফ লাইনের ১ থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের দামও ৩ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ইউনিট প্রতি ৩ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুতের পাইকারি দর নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিতর্ক ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। পিডিবি ইচ্ছাকৃতভাবেই বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। দেশের রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ এবং চুক্তি নবায়ন নিয়ে এই বিতর্ক বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ভাড়ায় চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো সাধারণত তিন, পাঁচ বা সাত বছরেরর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তাদের মূলধনী ব্যয়ের পুরোটা উঠে আসার কথা। এরপর বেসরকারী এই উৎপাদনকারীর শুধু পরিচলন এবং জ্বালানি ছাড়া অন্য খরচ থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের এখানে যখন চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে তখনও মূলধনী ব্যয় দেখানো হয়েছে। এসব কেন্দ্রের মূলধনী ব্যয় শূন্য ধরে চুক্তি করা হলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় এখন সাড়ে তিন টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু পিডিবি এখনও এর থেকে অনেক বেশি উৎপাদন ব্যয় দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, সারা বিশে^র যে তেলের দাম তাতে ৩০ টাকার বেশি লিটার দরে কোথাও তেল বিক্রি হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে সেই তেলের দাম অনেক বেশি রাখা হচ্ছে। এতে সরকার তেল বিক্রি থেকে লাভ করছে আবার বিদ্যুত বিক্রি করেও লাভ করছে। পৃথিবীর সবখানেই বিদ্যুত বিক্রিতে সরকার ভর্তুকি দেয় কিন্তু আমাদের এখানে ভর্তুকি প্রদান থেকে সরকার আস্তে আস্তে সরে আসছে। এতে শিল্প, বাণিজ্য এবং কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তিনি মনে করনে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন হবে। সাশ্রয়ী জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে এলএনজি ও তেল ব্যবহারের কারণে উৎপাদন খরচ কখনও কমবে না বরং বাড়বে। সঙ্গত কারণে সাশ্রয়ী বিদ্যুত দেয়ার যে ঘোষণা সরকারের হয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে না। তিনি বলেন, সাশ্রয়ী ও বড় বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে অগ্রগতি খুবই কম। কয়লা দিয়ে বড় কেন্দ্রের পরিকল্পনা করা হলেও সে বিষয়ে অগ্রগতি কম।
×