ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

বই ॥ জয় বাংলা পাঠানুভূতি

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

বই ॥ জয় বাংলা পাঠানুভূতি

‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসকে লেখক মুজিব ইরম বলেন আউট বই। মুক্তিযুদ্ধের এ উপন্যাসে দেখি দূর্মর সরলতা, সাবলীল গতি, সহজ সংলাপ, ৭১ এর একটি মহাঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের যুদ্ধদিনের জীবন কথা সে যেনো সারাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস, স্বজনহারা হাহাকার, মৃত্যুাতংক মন্বন্তর, কৈশোরের সারল্যপ্রেম, সাহসী বীরযোদ্ধা খসরুর লড়াকু জীবনসংগ্রাম, ডাক্তার আপার বিরতিহীন আহত মুক্তিকামীদের সেবা সংগ্রাম, তেরোবছরের এক তেজস্বি বালক কিশোর যুদ্ধের শুরুতে বাবা-মা, আশ্রিতাদের হারিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খসরুর আশ্রয়ে যুদ্ধে যাবার দিন গুণতে থাকে-আহত পায়ে গ্রাম পাড়ি দিয়ে রাতের বেলায় আরেক গ্রামে ডাক্তার আপাকে দেখাতে যায়। রাতের বেলায় সিকদার প্রধানের বাড়িতে রাত রেখে দিয়ে ভোরেই ডাক্তার আপাকে পা-টা দেখায়। তেজি কিশোর মনেপ্রাণে টগবগে যুবক-যুদ্ধই পারে বাঙালির মুক্তি আনতে এই সরল বিশ্বাসও তার অটুট। সেই সাদা বিশ্বাসে সে গ্রাম ছেড়েছে, স্বজন হারিয়েছে, জুলেখাকে কে ছেড়ে এসেছে, হরি নারায়নের ঘর ও বাঁশিও ছেড়েছে সে। তার একটাই পণ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনার। সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ খসরু যার প্রধান প্রেরণা। ক্যাপ্টেন কামাল লড়াকু কিশোরকে পড়ালেখা শিখিয়ে যুদ্ধপরবর্তী নতুন দেশের হাল ধরতে বলেছিলেন। নতুন দেশতো স্বাধীন দেশ-সোনার বাংলা। এর আগে ও মাঝে সিকদার প্রধানের কন্যা কিশোরী জুলেখার সাথে কথার বাণে ভেসে বেড়ানো, যুদ্ধদিনের সুখস্মৃতি পুত্র সন্তান মুক্তির জন্মানন্দ উৎসবে খাওয়া দাওয়ার মহড়া সেখানেই জুলেখা ও কিশোরের কথোপথন যেনো হেমন্তের শিশিরে ভেজা তরতরে গোলাপ পাঁপড়ি। কিশোরের বয়সি ছেলেদের থেকে এ কিশোর মনে, প্রাণে, ধৈর্যে,শক্তিতে একস্টেফ এগিয়ে। কথাশিল্পী মুজিব ইরম ‘জয় বাংলা’র শুরুতে সহজ সংলাপের মধ্য দিয়ে অতি সচেতনভাবেই এগিয়ে নিয়েছেন ঘটনা। আর এমন সরল শুরু যে কোন ধরনের পাঠককে টেনে রাখতে সক্ষম। পড়তে পড়তে পাঠকেরাও কখনো কিশোর হয়ে প্রেমাতির অতীত হয়, আবার লড়াকু খসরু হয়ে ওঠে, ক্যাপ্টেন কামালও হয় চুড়ান্তে আবির মাস্টারের আদর্শও উঁিচয়ে ধরে। কিশোর-জুলেখাও হয়ে যায় তারা। কিশোরের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠে-যুদ্ধদিন তার আসে। আসে কিশোরের থেকে দৈর্ঘ্যপ্রস্থে বড় বেঈমান বন্ধু টিপু যাকে সাহসী যোদ্ধা আবির মাস্টার আশ্রয় দিয়েছিলেন। টিপু তাদের আস্তানা পাক-হানাদারদের বলে দিয়েও প্রচন্ডভাবে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি তাকেও বাঁচিয়ে রাখেনা পাক-জান্তারা। আবির মাস্টারের প্রতি অমানষিক নির্যাতনেও ক্যাপ্টেন কামালের খবর মেলেনি। আবির মাস্টারের বুকে বুলেটের আঘাত আসার আগে কিশোরের প্রতি তার সংলাপ-কিশোরকে যুদ্ধ করে জয়লাভের আশ্বাস পাঠকান্তরকে আঘাত করে-আপন করে কিশোরের সাহস আর আবিদ মাস্টারের দেশপ্রেম। পাকসেলে বন্দি কিশোর অত্যাচার নির্যাতনে খোয়াব দেখে-দেখে জুলেখার সাথে সুখালাপ, ডাক্তার আপার ইনজেকশনের কথা মনে পরে যায় বিড়বিড়িয়ে উঠে, খসরু ভাইকে যুদ্ধ নিয়ে যেতে অনুরোধ করে, কিশোরের মা বলে ওঠে তারাতারি ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যেতে তার জন্য পিঠা তৈরী করা হয়েছে। মৃত্যুমুখে কিশোরের মুখের সংলাপ পাঠসংযোগের অনবদ্য নৈবেদ্য। পড়তে পড়তে কাঁদায়-কষ্ট দেয়। জয় বাংলা একটি বাস্তব ঘটনার উপাখ্যান। কিন্তু শিল্পী মুজিব ইরম ছোট ছোট কথাগুলো, টুকরো টুকরো ঘটনা একতায় বেঁধে যে ঐক্য-সংহতির প্রকাশ দেখিয়েছেন তা সামান্য নয়। সহজ সংলাপ কতো পাঠাকুতি জাগ্রত করে: ‘সে তার যাত্রা অব্যাহত রাখল। যদিও সে জানে না, কোথায় যাচ্ছে? যখনই কেউ তাকে জিজ্ঞসা করল, সে বলল : আমি দেখতে চাই নদীটি কোথায় জন্মেছে? আমি এই যুদ্ধাক্রান্ত দেশের পুরোটা দেখতে চাই। নদীর উজানে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে জয় বাংলা বলতে চাই। যেন সে নদীর ¯্রােতে ভাটিতে পৌঁছায়। আর আমার সোনার বাংলা স্বাধীন হয়ে যায়।’ মুক্তিযুদ্ধের একটি অঞ্চলের যুদ্ধ দিনরাতের কয়েকটি ঘটনা উঠে এসেছে এরকম হাজারো ঘটনা বাংলার পথে, প্রান্তরে, মর্মরে ছড়িয়ে রয়েছে। এ’তো সারাদেশের জয় বাংলা’। যুদ্ধদিনের ছোটছোট ঘটনা কতো অসামান্য হয় তার বিষ্ফার- জয় বাংলা এক কিশোর চরিত্রকে নিয়ে সব বয়সি পাঠকের জন্য খোলা থাকে জয় বাংলার পাতা। অনায়াস দেখা যায় সেইসব দৃশ্য ও দৃশ্যের মানুষগুলোর সুখ-দু:খ, ব্যথা-যন্ত্রণা! নদীপাড়ে কিশোর-জুলেখার প্রেমালাপ, বাংকারে কিশোর-আবিদ মাস্টারের গুলি ছোঁড়া, ড্রোন হয়ে উড়ে উড়ে কিশোর স্বপ্ন দেখে চারপাশ যুদ্ধ রাজাকারদের প্রতি ঘৃণার জখম, বুনো-পাকসেনাদের পরাস্থ হওয়া। খসরু, ক্যাপ্টেন কামাল, আবিদ মাস্টার, কিশোরেরা দেশ হয়ে ওঠে-স্বাধীন হয়ে যায় তারা-নতুন দেশে জয় বাংলার স্বপ্ন চাষ করে। জয় বাংলা সরল সত্যের আখ্যান। একাত্তরের একটি ঘটনাকে লেখক আন্তরিকতার সাথে-সত্যের সংশ্রবে বুনেছেন যুদ্ধদিনের শ্রুতিহীন, অদেখা গল্পটি যেখানে মুখ্য চরিত্রই অপ্রধাণ আর অপ্রধাণ চরিত্রই প্রধান হয়ে ওঠে বিধায় তা দুর্মর হয়েই প্রকাশ পায়। ভাষার সরলতা মানে এই নয় যে, সেখানে লেখকের ভবিষ্যবচন নেই-নিশ্চয় আছে আবার সর্বক্ষেত্রে বা গুণের উপাদানে, নির্মাণশৈলীও অনুদ্দিষ্ট নয়; বরং আউটবইটি সয়ম্ভূ তাও প্রশস্তপাঠে আবিষ্কার করা যায়। অপরদিকে উপন্যাসের শেষাংশে পাঠক ব্যথিত হতে পারে আবিদ মাস্টারের নির্যাতনের করুণ পরিণতি সঠিক করে জানা গেলোনা আবার কিশোরকে পাক-সামরিকজান্তা ও রাজাকাররা ছেড়ে দিলো না হত্যা করলো, কিশোর জুলেখার কাছে ফিরতে পেরেছে কি না সেসব জানতে পারা যায় না বর্ণনার মধ্যে এক্ষেত্রে শেষে এসে পাঠকদের মনে হতে পারে এ যেনো ছোট গল্পের সফল পরিসমাপ্তি। লেখক গৎবাঁধা ¯্রােতে না গিয়ে বরং বিপরীতে ছিটিয়ে থাকা এসব ইতিহাস ভিন্ন আঙ্গিকে, স্বকীয়ধারায় নির্মাণ করেছেন জয় বাংলা উপন্যাসটি। চারফর্মায় দেওয়ান আতিকুর রহমানের প্রচ্ছদে বেহুলা বাংলা থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির মূল্য ১৫০ টাকা।
×