ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গৌরব জি. পাথাং

স্মরণ ॥ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা অম্লান হোক তোমার প্রদীপ শিখা

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

স্মরণ ॥ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা অম্লান হোক তোমার প্রদীপ শিখা

নিজের জীবন প্রদীপ দিয়ে শিক্ষার আলো জ্বালাতে জ্বালাতে শেষে নিজের জীবন প্রদীপই নিভে গেল। সেই প্রদীপের নাম ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, সিএসসি। ১৩ অক্টোবর নটর ডেম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা ঢাকার সিটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা ছিলেন পবিত্র ক্রুশ সংঘের একজন সদস্য, এক মহামূল্যবান সম্পদ, বাংলাদেশ ক্যাথলিকম-লীর ধার্মিক এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও গর্ব, জাতির জন্য এক আদর্শ শিক্ষাবিদ, কঠোর পরিশ্রমী ও বিশ্বস্ত সেবক। আমি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে ফাদার বেঞ্জামিনকে অধ্যক্ষরূপে পেয়েছি। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম কলেজে অবস্থিত ম্যাথিস হাউসে এসে ফাদার বেঞ্জামিন কস্তাকে কাছে থেকে দেখেছি। তার ধার্মিকতা, কঠোর পরিশ্রম, দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বস্ততা সবাইকে অনুপ্রাণিত করত। দেখতে তিনি কঠোর; কিন্তু তার হৃদয় ছিল কোমল। তিনি অনেকের কাছেই ছিলেন বন্ধু, অভিভাবক ও পদপ্রদর্শক। ফাদার বেঞ্জামিনের জন্ম ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দরিপাড়া গ্রামে। পিতা ম্যাথিও কস্তা ও মা এলিজাবেথ পালমার ১১ সন্তানের মধ্যে ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা হলেন দ্বিতীয় সন্তান। তার জন্মের পর তার পিতা-মাতা পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর ধর্মপল্লীর রাজারদিয়ার গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে হলিক্রস হাইস্কুল বান্দুরা থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএ উত্তীর্ণ হন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে পাকবাহিনী জয়দেবপুরের অদূরে হিন্দুদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। সেই হিন্দুরা নাগরীতে মিশনে এসে আশ্রয় নেন। ফাদার বেঞ্জামিন তাদের সেবাযত্ন করেন। যুদ্ধশেষ হলে তিনি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম কলেজে অবস্থিত সেমিনারির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেমিনারিয়ানদের শিক্ষা দানের পাশাপাশি তিনি নটর ডেম কলেজে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এমএ পড়াশোনার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন এবং জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে কোর্স করেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে নটর ডেম কলেজে শিক্ষাদানের কাজে সম্পৃক্ত হন। সেই থেকে ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা দেন। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ২০১৩ থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ ক্যাথলিকম-লীর বিভিন্ন সেবা কাজে নিজেকে উজাড় করে দেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় অনেক পরিশ্রম করে তিনি নিজেই অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। তিনি খ্রিস্টদর্শন সেমিনারি ও রমনা সেমিনারির পরিচালক হিসেবে সেমিনারিয়ানদের শিক্ষা দিয়েছেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি রমনা সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রালের পালক পুরোহিত হিসেবেও খ্রিস্টভক্তদের সেবা দিয়েছেন। ১৯৯৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ কারিতাস’ সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সেবা দিয়েছেন। সেন্ট গ্রেগ্ররী হাইস্কুল, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার হাইস্কুল এবং আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস গাঙ্গুলী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের চেয়াম্যান হিসেবে তিনি স্কুল পরিচালনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ক্যাথলিক শিক্ষা কমিশনের সেক্রেটারিরূপেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতীয় টেক্সট বোর্ড ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনা করেন। তাঁর জীবন ছিল মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস। তাই তার মৃত্যুতে অনেকেই তাকে নিয়ে লেখালেখি ও স্মৃতিচারণ করছেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা ও ওয়ালিউল ইসলাম স্যারের সঙ্গে দেখা। সালাম দিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করতেই তারা বললেন, এক মেধাবী ছাত্র রেজাল্ট খারাপ করায় আত্মহত্যা করতে চাইছিল। তাই তাকে বোঝানোর জন্য তার বাড়িতে যাচ্ছেন। একজন প্রিন্সিপাল ছাত্রের খোঁজ-খবর নিবেন এমন আশা খুব কম। কিন্তু ফাদার বেঞ্জামিন তার ব্যতিক্রম। তিনি সব সময় ছাত্রদের খোঁজ-খবর নিতেন। আজ শিক্ষার আলো জ্বালাতে জ্বালাতে তার নিজের জীবন প্রদীপই নিভে গেল। আমার বিশ্বাস তিনি জীবন প্রদীপ থেকে মানুষের মনে যে আলো জ্বেলেছেন সেই এক আলো হতে লাখ প্রদীপ জ্বলবে যুগ-যুগান্তরে। তাই বলতে চাই অম্লান হোক তোমার প্রদীপ শিখা। সেন্ট জেভিয়ার ধর্মপল্লী ফৈলজানা, চাটমোহর, পাবনা। [email protected]
×