ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আরিফ আহমেদ

পাখির সংসার

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

পাখির সংসার

লম্বা লেজওয়ালা সাহেব বুলবুলি পাখিদের সমস্ত তথ্য বিবরণ আর এদের যাপিতজীবনের তাত্ত্বিক জ্ঞান সাঙ্গ করে এবার তাদের ফ্রেমবন্দী করতে গেলাম কুষ্টিয়ায়। গিয়ে আবারও পাখির বাসার খোঁজে লেগে গেলাম। প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেউ বাঁশ কেটে ফেলছে কিনা একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে- বসন্তের রাতে বিছানায় শুয়ে আছি; -এখন সে কত রাত! ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর। তারপর চলে যায় কোথায় আকাশে? তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে।’ ফেব্রুয়ারি মাসের কোন এক রাতে রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘পাখিরা’ নামের উপরের কবিতাটি পড়তে পড়তে হঠাৎ শৈশবে দেখা পাখিদের কথা মাথায় এলো, কেন কে জানে! কিন্তু খুব গাঢ়ভাবেই এলো। তবে পাখিদের ডানার ঘ্রাণ কেমন হয় আমার জানা নেই, আমার চোখের সামনে তখন কেবল শৈশবে তুমুল কৌতূহল জাগানিয়া লম্বা সাদা লেজের একটি পাখি ভাসছে। কিন্তু নাম মনে করতে পারছিলাম না তখন। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, এবার বাড়ি গিয়ে সেই পাখিটার খোঁজ করব। কারণ এরই মধ্যে আমি পাখিদের ছবিও তুলতে শুরু করেছি। সপ্তাহে মাত্র একদিন ছুটি। তবু পণ করলাম, এবার অন্তত শৈশবের দেখা অসম্ভব সুন্দর আর নান্দনিক পাখিটাকে আমার খুঁজে পেতেই হবে। কিছু না ভেবেই বৃহস্পতিবার রাতেই রওনা দিলাম কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের উদ্দেশে। চোখে স্বপ্ন, সেইসঙ্গে শৈশবের কৌতূহল পূরণের এক অদম্য বাসনা। পরদিন সকাল বেলায় বাস থেকে নেমে বিশ্রাম নেয়ার পর বিকেলের দিকে বরশি দিয়ে মাছ ধরব বলে পুকুরঘাটে বসে আছি। মাছ ধরার নেশা ছিল আমার সেই বাল্যকাল থেকেই। আর মাছ ধরার নেশায় আমি লম্বা লেজওয়ালা পাখিটির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম, অথচ সেবার এই পাখিটির জন্যই আমার বাড়ি যাওয়া। কিন্তু পুকুর পাড়ে হঠাৎ কিছু উড়ে যাওয়া দেখে মনে হলো কৌতূহল জাগানিয়া সেই বিশেষ পাখিটির কথা। বরশি হাতে থাকলেও আমার চোখ তখন পুকুর পাড়ের আশপাশের দিকেই যেন বেশি সচেতন হয়ে উঠল। কারণ, শৈশবে এই পুকুর পাড়েই সেই বিশেষ পাখিটিকে দেখেছিলাম। কিন্তু সচেতন হয়েও সেবার লাভ হয়নি। কোথাও দেখা পেলাম না পাখিটার। অনেককে পাখিটার বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেসও করলাম কোথায় আছে পাখিটি তারা জানে কিনা! বর্ণনা মতো সবাই পাখিটি চিনলেও পাখির বাসস্থানের সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। লম্বা লেজওয়ালা পাখিটিকে না দেখেই সেবার ঢাকায় ফিরে এলাম। আবার অফিস, নিজের ডকুমেন্টারি, মডেল ফটোগ্রাফি আর নানা কাজের চাপে ডুবে গেলাম। জীবনানন্দের কবিতা পড়ে শৈশবের যে পাখিটির কথা হঠাৎ মনে জেগে উঠেছিল তা আবার ভুলে গেলাম। কিন্তু একদিন বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফের বাসায় তার কম্পিউটারে এই পাখিটির ছবি দেখলাম। বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা আদনান আমার খুব ভাল বন্ধুও। লম্বা লেজওয়ালা পাখিটি তার পিসিতে দেখে ফের কৌতূহল জেগে উঠল। জানতে চাইলাম পাখিটি সম্পর্কে। সে জানাল, সুন্দরবনসহ দেশের সর্বত্রই দেখা গেলেও উত্তরাঞ্চলেই এই পাখিটি বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে নওগাঁ, বগুড়াসহ রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এর দেখা মেলে বেশি। তবে এসব বনে চষে বেড়িয়েও এই পাখিটির মনের মতো ছবি তুলতে না পারার আক্ষেপ তার মধ্যে সেদিন আমি দেখেছি। এমন কথা শুনে আমি তখন আরও কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। মনের মধ্যে একটা জেদও চেপে গেল বন্ধুর হতাশামাখা আক্ষেপের কথা শুনে। হৃদয় খুঁড়ে বন্ধু আদনান যেন ফের বেদনা জাগিয়ে দিল শৈশবের দেখা অসম্ভব সুন্দর পাখিটাকে নিয়ে। যেহেতু শৈশবে আমার এলাকাতেই পাখিটিকে দেখেছি, তার মানে এখনও পাখিটি কোথাও না কোথাও রয়েছে এমন বিশ্বাস নিয়েই মার্চের কোন এক বৃহস্পতিবার ফের কুষ্টিয়ায় বাড়ির পথে রওনা দিলাম। পরদিন ক্যামেরা হাতে পুকুরপাড়, পাশের বন বাদাড়ে মন দিয়ে পাখিটিকে খুঁজলাম। মাথায় তখন একটাই ভাবনা, যেভাবেই হোক লম্বা লেজওয়ালা পাখিটিকে আমি ফ্রেমবন্দী করবই এবং সবচেয়ে ভাল ছবিটাই তুলব এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে সারাদিন পাখিটিকে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। সারাদিন খুঁজেও যখন কোথাও পাখিটির সন্ধান পেলাম না, তখন কিছুটা হতাশ হয়ে গেলাম। তবে আশা একেবারে ছাড়িনি। কিন্তু অফিস থাকায় অগত্যা ঢাকায় ফিরে আসতে হলো। তবে মাথায় শুধু একটাই ভাবনা, কবে ফ্রেমবন্দী করব পাখিটিকে! জিদ যেন আরও চেপে বসল নিজের মধ্যে। এর কয়েকদিন পরেই অফিস থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে লম্বা লেজওয়ালা পাখিটির সন্ধানে ছুটে গোম উত্তরাঞ্চলে। বগুরা, রাজশাহী এবং নওগাঁর বিভিন্ন বাঁশবাগান ও জঙ্গলে খুঁজে ফিরেছি। অনেক কষ্টের পর বেশ কয়েক জায়গায় প্রথমবার দেখা পাই পাখিগুলোর। কিন্তু মনমতো পাখিগুলোকে ফ্রেমবন্দী করতে পারিনি। ছুটি শেষ হয়ে এলো, কিছুটা অসন্তুষ্ট মন নিয়েই আবারও ফিরে এলাম ঢাকায়। যথারীতি কাজে ডুবে গেলাম। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে আবার কুষ্টিয়ায় গেলাম এই পাখির খোঁজে। বাড়ি গিয়ে এর আগে এই পাখিটির জন্য আমি যে কয়েকদিন পুকুরঘাটে বসেছিলাম ঠিক এদিন সেখানেই লম্বা লেজওয়ালা পাখিটিকে দেখতে পেলাম। পুকুরঘাটে বসেছিলাম, হঠাৎ পাখিটি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দে দৌড়! পিছু নিলাম পাখিটির। এ গাছ থেক ও গাছ, এ ডাল থেক ও ডালে যাচ্ছে পাখিটি, কিন্তু আমি তার পিছু ছাড়তে রাজি না। আমি পাখিটির চূড়ান্ত যাত্রাপথ না দেখে কোনোভাবেই আজ কোথাও যাব না। পণ করলাম, তার আস্তানা আজকে যেভাবেই হোক দেখে যেতে হবে। কারণ অসম্ভব সুন্দর আর নান্দনিক লম্বা লেজওয়ালা পাখিটিকে দেখার পর আমি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেই যে এটাকে নিয়ে আমি শুধু ছবিই না, ভিডিও ডকুমেন্টারি নির্মাণ করব! যেই কথা সেই কাজ, সন্ধ্যার ঠিক একটু আগে আগে পাখিটির বাসস্থানের খোঁজ পেলাম। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যেখানে পাখিটির বাসা সেখানে একই পাখির আরও বেশ কয়েকটি বাসা দেখলাম। এমন দৃশ্য দেখার পর আমাকে আর পায় কে! ডকুমেন্টারির ভূত আরও গাঢ়ভাবে চেপে বসে মাথায়। তার আগে এই পাখিগুলোর চলন বলন তাদের খ্যাদ্যাভাস তাদের যাপিতজীবন সবকিছু সম্পর্কে আমাকে জানতেই হবে এমন ভাবনা থেকে ফের ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় ফিরে কাজে খুব একটা মন নেই। আমার মাথায় শুধু সেই পাখিদের আস্তানার কথা ঘুরছে, সেই বাঁশঝাড়ের কথা। কিন্তু এই পাখিদের সমস্ত কিছু রপ্ত করতে হলে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আমাকে জানতেই হবে। প্রথমে তাই পাখি নিয়ে বিভিন্ন দেশী বিদেশী বইগুলো সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করি। এর মধ্যে উপমহাদেশের বিখ্যাত পাখি বিশারদ সালিম আলী (একজন বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ এবং পপ্রকৃতিপ্রেমী), বিশিষ্ট পাখি বিশারদ ড. রেজা খান, পাখি বিশারদ ও সাহিত্যিক শরীফ খান, বিশিষ্ট পাখি বিশারদ ড. ইনাম আল হক, প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ রোনাল্ড আর হালদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খানদের( বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ) লেখা বই ও বিভিন্ন লেখাগুলো বিশেষভাবে আমাকে সহায়তা করেছে। শুধু পাখিদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকেই বেশ কয়েকদিন ডুবে রইলাম তাদের লেখা আর বইপত্রের সঙ্গে। আর সেখান থেকেই জানতে পারি আমি যে লম্বালেজি সুদর্শন পাখিটিকে খুঁজছি তার নাম দুধরাজ (ইংরেজী নাম Asian Paradise Flycatcher)। Monarchidae গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম terpsiphone paradisi। তবে অঞ্চলভেদে দুধরাজ, সাহেব বুলবুলি, শাহ-বুলবুল, সুলতান বুলবুল, নন্দনপাখি প্রভৃতি নামেও পরিচিত। দেখতে বুলবুলির মতো হলেও এ পাখি বুলবুলের সমগোত্রীয় নয়। এদের লম্বা দুধের মতো সাদা লেজ। কালো মাথা, তার ওপর নীলের প্রলেপ। নীলচে কালো রাজকীয় ঝুঁটি। চোখটা আকাশের মতো নীল! ঠোঁট থেকে সাধারণ লেজ পর্যন্ত এর মাপ প্রায় ১৯ থেকে ২১ সেন্টিমিটার। আর লেজের শেষ প্রান্ত থেকে লম্বা পালক দুটির দৈর্ঘ্য ২১ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার। মেয়ে পাখির চেয়ে ছেলে পাখির লেজ তিন গুণ বেশি লম্বা। ডিম থেকে ফোটার পর হাল্কা গোলাপিই থাকে এদের রং। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যখন সে যুবক, তখন বদলে যায় রং। সাদা-কালোয় হয়ে ওঠে স্বর্গীয় কান্তিমান। সময় লেগে যায় তিন থেকে পাঁচ বছর। পুরুষ সাহেব বুলবুলের দু’পর্ব। খয়রা ও সাদা পর্ব। দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত পুরুষ পাখি খয়রা পর্বে জীবন কাটায়। তারপর এদের গায়ের খয়রা রংটা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায়। পাখি বিশারদ ছাড়া অন্য যে কেউ প্রথম দেখলে দুটিকে দুই প্রজাতির বলে ভুল করবেন। সম্পূর্ণ বিপরীত চেহারা স্ত্রী দুধরাজের। ওদের লম্বা লেজ থাকে না। মাথায় ঝুঁটি রয়েছে তবে পুরুষের মতো আহামরি রূপ নেই। পিঠের রং হাল্কা বাদামি, পেটে ধূসরের সঙ্গে সাদার মিশ্রণ। এদের ডিমের রং সাধারণত গোলাপি রঙের। সারাদেশে পাওয়া গেলেও উত্তরাঞ্চলে তাদের বেশি দেখা যায়। এদের যেমন বনে দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় লোকালয়ের আশপাশে। তাদের পছন্দের স্থান হলো বাঁশঝাড়। আম কাঁঠালের বাগানেও তাদের দেখা মেলে। একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। উড়ে উড়ে বিভিন্ন ধরনের ডানাওয়ালা কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, ফড়িং ইত্যাদি শিকার করে। বাসার ত্রিসীমানায় বন বিড়াল, বেজি, বিষধর সাপসহ হাঁড়িচাচা পাখির মতো শিকারি পাখিরা এলেই কর্কশ কণ্ঠে ডাক ছাড়ে। মুহূর্তে এমন চিৎকারে শিকার করতে আসা প্রাণীটি ভড়কে যায়। দুধরাজের এই সাহসিকতার জন্য তার বাসার কাছাকাছি বসবাস করে কালোঘাড় রাজন, লেজ নাচানি, কমলা দামা, দোয়েল, বাবুনাইসহ নিরীহ পাখি। এপ্রিল-জুলাই দুধরাজের প্রজননকাল। এ সময় স্ত্রী-পুরুষ মিলে বাঁশঝাড়ের চিকন কঞ্চি ও গাছের দোডালা বা তেডালায় শিকড়, ঘাস, লতাপাতা, মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির খুব সুন্দর বাসা বানায়। এরা ডিম দেয় তিন থেকে চারটি। বাবা-মা উভয়েই ডিমে তা দেয়। তা থেকে দুই-তিনটি ছানা বড় হয়। সব ডিম ফোটে না। যেগুলো ফোটে তার সব বাচ্চাও বাঁচে না। এদের ছানার মৃত্যুর হার অন্যদের চেয়ে বেশি। সে কারণে দুধরাজের সংখ্যা বরাবরই কম। দুধরাজ দম্পতি থাকে একসঙ্গেই। গড়পড়তা ১০-১২ বছরের জীবন দুধরাজের। এরপর সীমাহীন জীবনের পথে যাত্রা। লম্বা লেজওয়ালা সাহেব বুলবুলি পাখিদের সমস্ত তথ্য বিবরণ আর এদের যাপিতজীবনের তাত্ত্বিক জ্ঞান সাঙ্গ করে এবার তাদের ফ্রেমবন্দী করতে গেলাম কুষ্টিয়ায়। গিয়ে আবারও পাখির বাসার খোঁজে লেগে গেলাম। প্রথমে খোঁজে পাচ্ছিলাম না। কেউ বাঁশ কেটে ফেলছে কিনা একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছিলাম সেদিন। তারপর দেখি বাঁশ অনেক ওপরে উঠে গেছে, কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ! তবে সাহেব বুলবুলির বাসাটি অক্ষত আছে। সেই সঙ্গে আরও বেশকিছু সাহেব বুলবুলির বাসাও ঠিকঠাক পেলাম। একসঙ্গে এত সাহেব বুলবুলি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর পাখি, অথচ এগুলো একেবারেই আমাদের দেশীয় পাখি। সেই শৈশবে যাদের দেখেছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে তাদের চলন বলন সম্পর্কে একটা ধারণা নেয়ার চেষ্টা করলাম। কি করে, কখন কোথায় যায়, কিভাবে খাদ্য সংগ্রহ করে, পুরুষ আর স্ত্রী পাখিদের মেলামেশা, বাচ্চা পাখিদের খাবার দেয়া এ সমস্ত কিছুই সকাল থেকে রাত অবধি বসে থেকে দেখেছি। এর মধ্যে কিছু স্থিরচিত্রও নিয়েছি। কিন্তু আমার তো মাথায় কিভাবে এদের বশ করে তাদের ক্লোজ হয়ে ভিডিও করা যায় সেই ধান্দা!কিন্তু আবার এটাও আমার মাথায় ছিল, কোনভাবেই পাখিগুলো যেন আমাকে ভয় না পায়। কারণ আমার দ্বারা সামান্য ভায়োলেন্সের আভাসও যদি তারা পায় তাহলে পাখিগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যাবে। তাই কিভাবে তাদের ভয় না পাইয়ে কাজটা হাসিল করা যায় সেই পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু কাজের চাপে আবারও ঢাকায় ফিরে আসত হলো। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে সাহেব বুলবুলিকে ফ্রেমবন্দী করতে সেখানে গিয়েছি। এ সময় কুষ্টিয়ার বার্ডস ক্লাবের সভাপতি ও পাখি বিশারদ এসআই সোহেল ভাইকেও লম্বা লেজওয়ালা দুধরাজের সন্ধান জানাই। তিনিও তখন পাখিটি নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখান। আর দুধরাজের ছবি তুলতে সে সময় আমাকে নানাভাবে সহায়তা করেছে দৌলতপুর বার্ড ক্লাব ও স্থানীয় জনগণ। আমার মাথায় তখন একটি চিন্তায় যে, দুধরাজের ভাল কিছু স্থিরচিত্র ও একটি ডকুমেন্টারি করতে চাই। তাদের বাসা নির্মাণ থেকে শুরু করে তাদের জীবন, বেড়ে ওঠা, বাসস্থান রক্ষণাবেক্ষণ, প্রজনন, ডিমে তা দেয়া, বাচ্চা ফুটানো, বাচ্চাদের খাবার যোগানো এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজ বাচ্চাদের রক্ষা করার বিষয়টি ভিডিওতে তুলে ধরতে চাই। আর এর জন্য এদের সঙ্গে প্রচুর সময় দেয়া জরুরী হয়ে পড়ে। অবশ্য সময় নিয়ে কোন কৃপণতা করিনি। আর এ কাজে অফিসের সহায়তাও মনে রাখার মতো। এপ্রিল মাস থেকেই নিয়মিত বিরলপ্রজ এই দেশীয় সাহেব বুলবুলির ওপর কাজ শুরু করি। প্রথম কয়েক সপ্তাহ লেগেছে শুধু এই পাখিটির বাসা নির্মাণ ফ্রেমবন্দী করতে। এর মাঝে একবার প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে গিয়ে দেখি তাদের বেশিরভাগ বাসায় আর নেই। ঝড়ে ভেঙ্গে গেছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষ যেভাবে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বাঁচে, পাখিদেরও তেমনি যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় এই বিষয়টা তখন অনুধাবন করি। দেখি, ঝড়ে যাদের বাসা ভেঙ্গে গেছে তারা আবার নতুন বাসা গড়ছে। এগুলোও ছবি ও ভিডিও করলাম। এরপর তাদের ডিম পাড়া, ডিমে তা দেয়া এবং প্রজননকাল পুরোটাই ঠিকঠাকভাবে শূট করি। এরপর টানা তিন মাস এই পাখিগুলোর পেছনে রাত-দিন পড়ে রইলাম। একটু সময় পেলেই ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া চলে গিয়েছি। পাখিদের সঙ্গে আমারও নতুন একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে ততদিনে। মনে হচ্ছিল, আমি তাদের ভাষা বুঝে গেছি। কারণ তাদের যাপিতজীবনের সমস্ত কিছুই ততদিনে আমার নখদর্পে। তবে তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে একদিন একটি দৃশ্য আমার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। একদিন আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকায় ক্যামেরার পুরোটা পানি নিরোধক পলিথিন পেপার লাগিয়ে পাখির বাসার দিকে তাক করে আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। যে বাসাটির দিকে ক্যামেরা তাক করা ছিল সে বাসাতে দুটো বাচ্চা পাখি ছিল। হঠাৎ দেখি তাদের মা কোথা থেকে উড়ে এসে বাচ্চা পাখিদের ওপর ডানা মেলিয়ে দিয়ে বসে পড়েছে, যেন বাচ্চাদের শরীরে বৃষ্টি না পড়ে। এমন পবিত্র আর মোহনীয় দৃশ্য দেখে আমার চোখে জল চলে আসে। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য মানুষের মধ্যেও এখন বিলুপ্তপ্রায়। তখন ডকুমেন্টারির কাজটি প্রায় শেষের দিকে। সব কাজ গুটিয়ে ঢাকায় ফিরে আসব, কিন্তু তার আগে শেষ দিনের শূটে একটি গাছের মগডাল থেকে দুধরাজের বাসার দিকে ক্যামেরা ধরে আছি, তারপর যে দৃশ্য দেখলাম তা অত্যন্ত অমানবিক একটি দৃশ্য! হঠাৎ দেখি বাচ্চা দুটির একটি নেই। একটু দূরেই দেখতে পেলাম হাঁড়িচাচা নামের আরেকটি পাখিকে, যে কিনা বাচ্চা দুধরাজটিকে মেরে ফেলেছে। শুধু তাই না, দূরে দাঁড়িয়ে জীবিত বাচ্চাটিকেও খাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছে পাখিটি। তার একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাঁড়িচাচাকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে মা দুধরাজটি। কিন্তু হাঁড়িচাচার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। গাছের মগডালে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে এসব ভয়ঙ্কর মুহূর্ত দেখছি। আমার তখন বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। ছবি তুলতে গিয়ে যে পাখিগুলোর সঙ্গে আমার কয়েক মাসের সম্পর্ক, অথচ সে পাখিগুলোর ওপর এমন আক্রমণ আমি হা করে তাকিয়ে দেখছি! কিছুই করতে পারছি না। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে এ রকম হৃদয়বিদারক মুহূর্তগুলো দেখছি আর অকৃতজ্ঞের মতো ক্যামেরায় ক্লিক করছি! হঠাৎ দেখি হাঁড়িচাচা দুধরাজের বাসায় থাকা অবশিষ্ট বাচ্চাটিকেও ছুঁ মেরে নিয়ে গেল। পাশেই হাঁসফাঁস করতে থাকা বাবা ও মা দুধরাজ পাখি দুটি চিৎকার করে ওঠে। তখনও আমার কিছুই করার ছিল না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া! মগডাল থেকে নেমে যাই, তখনও দুধরাজ পাখি দুটি তাদের বাচ্চাদের জন্য বিলাপ করছে। মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এমন আকস্মিকতায় সত্যিই আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ঢাকায় ফিরতে পথে বার বার এই বাচ্চাগুলোর কথাই মনে পড়ছিল খুব। আর সেই সঙ্গে ভাবছিলাম দিনকে দিন দুধরাজ/সাহেব বুলবুলির মতো দেশীয় পাখিগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছে সে কথা! খোঁজ নিয়ে দেখলাম ইকো সিস্টেম আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই, সেই সঙ্গে কিছু লোভী মানুষের উৎপাতও তাদের হারিয়ে যাওয়ার জন্য কম দায়ী নয়। যেভাবেই হোক এই পাখিগুলোকে আমাদের রক্ষা করা উচিত। তা না হলে দেশের সব পাখিই একদিন হুমকির মুখে পড়বে। যা আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে...
×