ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আয়নাতে ঐ মুখ সোনালি দিনের সমৃদ্ধ ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ২৩ আগস্ট ২০১৭

আয়নাতে ঐ মুখ সোনালি দিনের সমৃদ্ধ ইতিহাস

মোরসালিন মিজান কোটি কোটি টাকার সিনেমা এখন। বড় লগ্নি। দেশ-বিদেশে শূটিং। নায়ক-নায়িকার অভাব নেই। রং আছে। রূপ আছে। আছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা। এরপরও অধিকাংশ সিনেমা সিনেমা হয়ে উঠছে না। বাংলা চলচ্চিত্রের যে গৌরবের ইতিহাস, সে ইতিহাসে নতুন করে যোগ করতে পারছে না তেমন কিছু। এখনও বাংলা চলচ্চিত্র বলতে বিশ শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের প্রারম্ভে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোকেই বোঝায়। এসব ছবিতে সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনবোধ, সংগ্রাম ও প্রেমের অনুভূতিগুলোকে ভীষণ যতেœর সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। শিল্পিত উপস্থাপনা দেখতে আজও অতীতেই ফিরে যেতে হয়। আর তখনই অত্যুজ্জ্বল তারকাটি হয়ে সামনে আসেন নায়করাজ রাজ্জাক। রূপালী পর্দা আর স্বর্ণালি সময়ের প্রতিনিধি তিনি। ভ্রমর যে এসেছিল জানবে লোকে...। জানান দিয়ে এসেছিল ভ্রমর। তার পর কত শত ছবিতে অভিনয়! নিজে যেমন জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তেমনি সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলা সিনেমা ও বাংলাদেশের সিনেমাকে। নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা...। বাস্তবে একা পথ চলেননি তিনি। চলচ্চিত্রের শিল্প সুন্দর সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং রাজ্জাক বলা চলে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছেন। তাকে অনুসরণ করলে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অনেকখানি জানা হয়ে যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস পাঠ করতে গেলেও অনিবার্য পাঠ হয়ে আসে নায়করাজ রাজ্জাক প্রসঙ্গ। পঞ্চাশের দশকে, যখন পাকিস্তান আমল, চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন রাজ্জাক। উর্দু সিনেমার দাপট ছিল। রাজ্জাকও অভিনয় করেন উর্দু সিনেমায়। তবে নিজেকে খুঁজে পান বাংলাতেই। তখন লোককাহিনী নির্ভর বাংলা সিনেমা বেশি নির্মিত হতো। এই ধারার অন্যতম নির্মাণ ‘বেহুলা।’ কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা যায় রাজ্জাককে। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরকে দর্শক পর্দায় আবিষ্কার করেন ১৯৬৬ সালে। ছবিতে লখিন্দরের বেশে উপস্থিত হওয়া রাজ্জাককে ভীষণ মনে ধরে যায় দর্শকের। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় ‘নীল আকাশের নিচে।’ কাহিনীকার ছিলেন ইসমাইল মোহাম্মদ। পরিচালনা করেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। তৎকালীন বাঙালী পরিবারের গল্প নিয়ে নির্মিত ছবি আর ছবি হয়ে থাকে না। বাঙালীর জীবনের গল্প হয়ে যায়। অনন্য সুন্দর সফল চলচ্চিত্রে রোমান্টিক নায়কটি ছিলেন রাজ্জাক। মিষ্টিমুখ কবরীর বিপরীতে তার অভিনয় কার হৃদয়ে দাগ কাটেনি? খুঁজে পাওয়া যাবে তেমন কোন দর্শক! মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে দেশ ও রাজনীতি যারপরনাই উত্তপ্ত। চূড়ান্ত বিদ্রোহ ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাঙালী। ঠিক তখন এপ্রিল মাসে মুক্তি পায় জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া।’ সামাজিক এই চলচ্চিত্রে বাঙালীর বঞ্চনার ইতিহাস ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রূপকের আশ্রয়ে তুলে ধরা হয়। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা ছবিতে আরও অনেক খ্যাতিমান অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেন রাজ্জাক। কিন্তু তার চরিত্রটিতে একই সঙ্গে বাঙালীর প্রতিবাদ ও প্রেমময় চেতনার প্রকাশ ঘটে। চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং অভিনয় দুটিই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন দর্শক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা সিনেমা এবং বাংলাদেশের সিনেমা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। উর্দু পালায় পাকিস্তানে। বাংলা সিনেমার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। প্রথম বছরই মুক্তি পায় ৮টি চলচ্চিত্র। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খুব যৌক্তিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে বাংলা সিনেমার মূল পটভূমি। এ পটভূমিতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রটির নাম ‘ওরা ১১ জন।’ এখানেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় রাজ্জাককে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ‘রংবাজ।’ এই ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এ্যাকশনের সূচনা করেন রাজ্জাক। তার অভিনীত এ ছবিটিই বাংলাদেশের প্রথম এ্যাকশনধর্মী ছবি। নিজ চলচ্চিত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের ব্যানারে ছবিটি নির্মিত হয়। বাণিজ্যিকভাবে ছবিটি দারুণ সফলতা লাভ করে। পরের বছর ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘আলোর মিছিল।’ নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ছবিতে আরেক বিখ্যাত নায়ক ফারুকের সঙ্গে অনবদ্য অভিনয় করেন রাজ্জাক। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘অশিক্ষিত।’ ছবিতে কিছুটা বয়স্ক রাজ্জাকের দেখা মেলে। আজিজুর রহমান পরিচালিত ছবিতে রোম্যান্টিক নায়ক ছিলেন না তিনি। ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে রূপদান করেন। একটি কিশোর চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে অভিনয় করা, বন্ধুতার সম্পর্ক, দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেন। ঠিক দুই বছর পর আশির দশকের শুরুতে মুক্তি পায় আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা।’ ঈদের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের বাথরুমে সকলের অজান্তে আটকে পরা কিশোরের নির্মম মৃত্যুর গল্প নিয়ে শিশুতোষ এই চলচ্চিত্র। রাজ্জাক এখানে মূল চরিত্র ছিলেন না। কিন্তু যে চরিত্রে রূপদান করেন, সেটিও স্বতন্ত্র আবেদন নিয়ে সামনে আসে। ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় ‘বড় ভালো লোক ছিল।’ রাজ্জাক অভিনীত এ ছবিটিও দর্শক মুগ্ধ হয়ে দেখেন। এভাবে আরও আরও ছবি। এসব ছবিতে আলাদা আলাদা সময়। স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট। বহুবিধ চরিত্র। কিন্তু রাজ্জাক একজনই। তার অভিনীত ছবিগুলো দেখলে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস অনেকখানি পাঠ করা হয়ে যায়। কখনও চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়ের ইতিহাস উদ্যোগী হয়ে রাজ্জাককে তার উপদান করেছে। কখনও রাজ্জাক নিজেই জন্ম দিয়েছেন ইতিহাসের। আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন... দেখা হয়ে যাবে ইতিহাসটিও।
×