ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৫ লক্ষাধিক প্রান্তিক চাষী ও ব্যবসায়ী পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন;###;অস্তিত্বহীন লবণমিল মালিক ও সিক্সমিল সিন্ডিকেটের কারসাজি

আমদানির সিদ্ধান্তে হতাশ লবণ চাষীরা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৭ জুলাই ২০১৭

আমদানির সিদ্ধান্তে হতাশ লবণ চাষীরা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ সরকারের লবণ আমদানির সিদ্ধান্তের কারণে আমদানিকারকরা খুশি হলেও হতাশায় ভর করছে তৃণমূল চাষীদের। তাদের ভাষ্য, সরকার বৃহত্তর চিন্তায় আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও সিক্সমিল সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে পড়তে পারে লবণশিল্প। পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও আড়ালে ঢুকে যেতে পারে অতিরিক্ত লবণ। দেশে লবণের সরবরাহ ও বাজার স্বাভাবিক রাখতে গত জুনে শিল্প মন্ত্রণালয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিন লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমতি দিয়েছে পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানির। প্রাক্কলিত ঘাটতির চেয়ে দুই লাখ টন বেশি আমদানির এ সিদ্ধান্তে দেশীয় লবণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এতে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। যার মাশুল গুনতে হবে প্রান্তিক চাষীদের। তাছাড়া মিল মালিক নয়, এমন লোকও ভুয়া মালিকানা দেখিয়ে লবণ আমদানিতে কারসাজি শুরু করেছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। যা প্রকৃত লবণ মিল মালিকদের উপর প্রভাব ফেলবে। সূত্র জানায়, মহেশখালীতে কোন ধরনের লবণ মিলের অস্তিত্ব না থাকলেও সংশ্লিষ্ট মহলকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবছর বেশ কয়েকটি মিলের নামে লবণ আমদানির আবেদন করে কিছু রাঘব-বোয়াল। অস্তিত্বহীন মিলসমূহের মধ্যে রয়েছে- আলিফ সল্ট, আল মোস্তফা সল্ট, সাগরিকা সল্ট, নিউ বিসমিল্লাহ সল্ট। আলিফ সল্টের নামে গতবারও লবণ আমদানি করা হয়েছিল। একইভাবে সদরের ইসলামপুরে ন্যাশনাল আয়োডাইজ সল্ট, রাইসা সল্ট, মাজেদা সল্ট, গোমাতলীতে সাগর সল্ট, চকরিয়া ডুলাহাজারায় চৌধুরী সল্টের কোন অস্তিত্ব নেই। ইসলামপুরে শাহ মজিদিয়া সল্ট, পপুলার সল্ট, শহরের আলীর জাহালের নুর সল্ট নামে মিলের কোন কার্যক্রম নেই বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরে দেশে লবণের চাহিদা ১৫ দশমিক ৭৬ লাখ টন। এর বিপরীতে গত জুনে শেষ হওয়া মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ লাখ টন। এ হিসেবে চাহিদার তুলনায় লবণের ঘাটতি আছে ২ লাখ ১২ হাজার টন। বিসিক লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোঃ আবছার উদ্দিন জানান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী (আংশিক) অঞ্চলের ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়। গত ১৫ জুন শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক সভায় বিসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবার ঘূর্ণিঝড় মোরা, আগাম বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণের উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। সভায় চলতি বছরের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার টন ঘাটতি প্রাক্কলন করে তিন লাখ টন লবণ আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অথচ ৫ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়। বাংলাদেশ লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোস্তাফা কামাল চৌধুরী বলেন, আসন্ন কোরবানির ঈদের সময় কিছুটা সঙ্কট দেখা দিতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সভায় তিন লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন তা কেন পাঁচ লাখ টন হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। অতিরিক্ত লবণ আমদানি হলে লক্ষাধিক প্রান্তিক চাষী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন আগামী মৌসুমে কেউ আর লবণ উৎপাদন করতে আগ্রহী হবে না। কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি সামশুল আলম আজাদ বলেন, হঠাৎ পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানি করলে কয়েক শ’ ছোট লবণ মিল মালিক ও কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। তিনি প্রস্তাব করেন, ঘাটতি মেটাতে আগে তিন লাখ টন আমদানি করা হোক। তার পরও সঙ্কট থেকে গেলে তখন না হয় আরও দুই লাখ টন লবণ আমদানি করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ছোট মিলগুলো এখন ২০ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লবণ বাজারজাত করছে। অথচ বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ লবণ বিক্রি করছে কেজিপ্রতি ৪৫ টাকায়। এরাই লবণের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। লবণ চাষীদের অভিযোগ, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রিক পরিতোষ গংদের ‘সিক্সমিল সিন্ডিকেট’ সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এবং দেশে কৃত্রিম লবণ সঙ্কট দেখিয়ে ভারত থেকে লবণ আমদানি করে আসছিল প্রতিবছর। এতে নিজেরা লাভবান হলেও দেশের স্বনির্ভর লবণ খাতকে বিপর্যস্ত করে রাখে চিহ্নিত চক্রটি। গত বছরের ১৪ আগস্ট দেড় লাখ মেট্রিকটন লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। সেখানে আরও অন্তত দুই লাখ মেট্রিকটন অতিরিক্ত লবণ ঢুকে পড়েছে দেশে। লবণ চাষী ফরিদুল আলম বলেন, চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত লবণ আমদানি করা হলে বাজারে প্রভাব পড়বে। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে তৃণমূলের লবণচাষীরা। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। সূত্র মতে, লবণের ব্যাপক চাহিদার কারণে উৎপাদিত লবণ পরিশোধন ও বাজারজাত করণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক লবণ মিল-কারখানা। এসব মিলের মধ্যে শুধু কক্সবাজার সদরের বিসিক শিল্প নগরী ইসলামপুর কেন্দ্রিক ৩৫ মিলসহ জেলায় ছোট বড় মিলে গড়ে উঠেছে অন্তত ৫০টি লবণ কারখানা। এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে অন্তত ৫ লক্ষাধিক কৃষক তথা প্রান্তিক চাষী ও ব্যবসায়ী পরিবার। কিন্তু উৎপাদিত লবণ ও লবণের মিল-কারখানাগুলো দেশের ৬টি রাঘব বোয়াল মিলারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
×