ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এ কে আবদুল মোমেন

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণের বাজেট

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৭ জুলাই ২০১৭

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণের বাজেট

বাজেট নিয়ে এবার অনেক বিতর্ক হলো যা দেশের জন্য ভাল। তবে বিতর্ক যদি ব্যক্তি বিশেষের ওপর বিষোদগার না হয়ে বস্তুনিষ্ঠ হতো, তাহলে আরও ভাল হতো। তবে সুখের বিষয় যে, এসব আলোচনা-সমালোচনায় জনগণের মঙ্গল হয়েছে, বাজেটটি জনবান্ধব হয়েছে এবং বাজেট যে শুধুমাত্র কয়েকটি অঙ্কের সমাহার নয়- এর জীবন আছে, এর প্রয়োজনে মানুষের যেমন উপকার হবে, একইভাবে অতিরিক্ত করের বোঝায় মানুষের জীবন অভিশপ্ত হতে পারে- এ সত্যটি আবার প্রমাণিত হলো। নির্বাচনের আগে অতিরিক্ত ভ্যাট বাধ্যতামূলক করলে ভোটের খেলায় পরাজয় হতে পারে, সরকারী দলের পুনঃনির্বাচনে জয় বাধাগ্রস্ত হতে পারে-এ উপলব্ধি নিশ্চয়ই উত্তম। শুধু ভ্যাটের ক্ষেত্রে নয়; গুটিকতেক পুলিশের অতিমাত্রায় খবরদারি ও অত্যাচার বা সরকারী কর্মচারী অথবা কোন কোন দলীয় নেতৃত্বের দুর্নীতি বা অবিচার যে ভোটের খেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তার উপলব্ধিও অতীব প্রয়োজন এবং সেই মতে কাজ করা প্রয়োজন বৈকি। বস্তুত গুটিকতেক দুর্নীতি পরায়ণ লোকের জন্যে বা অতি উৎসাহী কর্মচারী বা দলীয় নেতৃত্বের জন্য সময় সময় সরকারের বহুবিদ উন্নয়ন এবং জনবান্ধব সেবা ম্লান হয়ে যায়। যেমন বেসিক বা সোনালী ব্যাংকের কেলেঙ্কারি বা হরিলুুট এবং অসৎ লোকদের যথোপযুক্ত শাস্তি না দেয়ায় বা আড়াল করায় সরকারী ও বিরোধী দলীয় সাংসদরা এক বাক্যে সরকারের ওপর বিষোদাগার করেছেন এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ঝপধঢ়বমড়ধঃ বা ‘বলির পাঠা’ বানিয়েছেন। তবে এসব ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়করা কিন্তু আড়ালেই থেকে গেলেন। সমালোচকরা বলেছেন ‘চোরের গলা বড় গলা’ এবং এদের মধ্যেই অনেক রাঘব গোয়াল রয়েছেন, যারা সরকারের সুযোগ-সুবিধা অন্যায়ভাবে নিয়েছেন এবং তারা সরকার থেকেও ক্ষমতাবান এবং এর ফলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থমন্ত্রী কোন কেলেঙ্কারির রিপোর্টটিও জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেননি। কোন একজন মাননীয় সংসদ ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে সরকারী অনুদান প্রদানকে ‘ক্রিমিনাল’ আইনের আওতায় এনে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জেলে পাঠাতে সুপারিশ করেছেন। ব্যাংকগুলোকে সচল না রাখলে যে বহুলোকের চাকরি যাবে, অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হবে - এক এক করে কয়েকটি ব্যাংক যদি দেউলিয়া হয়ে যায় বা লালবাতি জ্বলে তাহলে তার ফলে বৃহত্তর অর্থনীতির ওপর এর যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা হয়তো তিনি ভেবে দেখেননি। তিনি হয়তো জানেন না যে, ২০০৮ সালে যখন মার্কিন অর্থনীতিতে ধস নামে তখন অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয় বা লালবাতি জ্বলে। যখন আরও অনেক বড় ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিল তখন এগুলোকে জিইয়ে রাখার জন্য প্রথমে বুশ প্রশাসন এবং পরবর্তীতে ওবামা প্রশাসন দু-দুবারে সর্বমোট ৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়ে মার্কিন ব্যাংকসমূহ ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখেন এবং এর ফলে গোটা বিশ্ব অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এই ভর্তুকিকে তারা ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ (ঝঃরসঁষঁং চধপশধমব) হিসাবে আখ্যায়িত করেন। আমাদের দেশেও পোশাক শিল্পকে চাঙ্গা রাখার জন্যে ‘স্ট্রিমুলাস’ বা ‘প্রণোদনা’ প্রদান করা হয়। যাই হোক এসব বিতর্কে না গিয়ে যে জিনিসটি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, সরকার দলীয় মন্ত্রীরাও যারা প্রস্তাবিত বাজেটটি মন্ত্রিসভায় পাস করেছেন তারাও এ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য রাখেন। প্রস্তাবিত বাজেটটি অর্থমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন এবং উপস্থাপন করার আগে তা মন্ত্রিসভায় চুল-চেরা বিশ্লেষণ করে মন্ত্রিসভার সকল সদস্যের সম্মতিতে তা গৃহীত হয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রিসভার মিটিং এ মাননীয় মন্ত্রীরা তাদের সুপারিশগুলো কি তুলে ধরেছিলেন? এবং তুলে ধরার পর যখন তা গৃহীত হলো না তখন তারা কেন তা মেনে নিলেন? মোট কথা মন্ত্রিসভা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে প্রস্তাবিত বাজেট গৃহীত হয় এবং প্রস্তাবিত বাজেটটি যেহেতু ‘যৌথ বা জয়েন্ট দায়-দায়িত্ব’, তাহলে একজনের ওপর এত গলাবাজি কেন? ভ্যাটের বিষয়টি ২০১২ সালে এ সরকার গ্রহণ করে এবং গেল বছর তা বাস্তবায়ন না করে এ বছরে করবে বলে প্রস্তাব দেয়। প্রাক-বাজেট আলোচনায় নতুন ভ্যাট আইন এ বছরে চালু না করার জন্য সুপারিশ এসেছে, তবে অর্থ মন্ত্রণালায় ও মন্ত্রিসভা তা আমলে নেয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটের তিনটি ইস্যু সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এগুলো হচ্ছে- (১) নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়নের প্রস্তাব (২) ব্যাংকে সঞ্চয়ী এ্যাকাউন্টের ওপর আবগারী শুল্ক আরোপ এবং (৩) লোকসানি ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দকরণ এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ মার্কেট-ভিত্তিক করার সুপারিশ। উল্লেখ্য যে, গৃহীত বাজেটে (১) ও (২) নং বাতিল হয়েছে এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ এখনও আগের মতো অধিক রয়ে গেছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগণের যাতে অসুবিধা না হয় সে জন্যে এক্ষেত্রে পুরনো সুদ রাখা হয়েছে যেহেতু এদের অনেকেই সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভরশীল। তবে তারা এক্ষেত্রে আবগারী শুল্কের মতো ব্যবস্থা নিতে পারতেন। ইনস্টিটিউশন বা কর্পোরেট সঞ্চয় পত্রের ওপর আলাদা সুদ নির্ণয় করা হয়তো অযৌক্তিক নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে এ কয়েকটি দুর্বলতা ছাড়া, বাজেটটি অত্যন্ত উন্নতমানের। বস্তুত বলা চলে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে এবং দেশরতœ শেখ হাসিনার ‘ভিশন ২০২১’ ও ‘ভিশন ২০৪১’ অর্জনের এ হচ্ছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার এবং রোডম্যাপ। তাই অর্থমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন যে এ বাজেট হচ্ছে তার ‘শ্রেষ্ঠ বাজেট’। যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘রূপকল্প’ বা ‘ভীষণগুলো’ অর্জন করতে হয় তাহলে এ বাজেটের বিকল্প সীমিত। ২০১৭-২০১৮ সালের বাজেট বিগত কয়েকটি বাজেটের ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি ও অর্জন। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, উন্নয়নের মহাসড়কে আমরা যে যাত্রা শুরু করেছি তা চরিতার্থ করা এবং অর্জন করা। এজন্যেই এ বাজেটে উন্নয়ন বা ডিভেলপমেন্ট খাতে অধিক বরাদ্দ ধরা হয়েছে। ২০১৬-২০১৭ সালে ডিভেলপমেন্ট খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৫ভাগ, বর্তমান বাজেটে ৪১ ভাগে বর্ধিত করা হয়েছে যা চাট্টিখানি কথা নয়। ২০১৭-২০১৮ বার্ষিক বাজেট মোট বাজেট (কোটি টাকা) উন্নয়ন বাজেট (কোটি টাকা) অনুন্নয়ন বাজেট (কোটি টাকা) ৪,০০,২৬৬ ১,৫৩,৩৩১ (৩৮.৩%) ২,৩৬,১৮২ (৫৯.০%) স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহ ১০,৭৫৩ (২.৬৯%) = ৪১% অর্থাৎ মোট বাজেট যা ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেটে সর্বমোট ব্যয় হচ্ছে ১,৬৪,০৫৮ কোটি টাকা বা ৪১% শতাংশ। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন দিন দিন অধিকতর খারাপ হচ্ছে। ২০০৮-২০০৯ সালে উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন ছিল প্রায় ৮৯.৪ ভাগ এবং তা ২০১০-২০১১ সালে বর্ধিত হয়ে দাঁড়ায় ৯৭.১ ভাগে। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে বাস্তবায়ন দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে, যেমন: ২০১৫-২০১৬ তে তা দাঁড়ায় ৭৬.২৬ শতাংশ। সেজন্য বাজেট বাস্তবায়নের ওপর সমধিক জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে বেহুদা কাজে অপচয় না হয় তার জন্য তদারকি বাড়ানো দরকার। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ যে, সিলেট সুনামগঞ্জ এলাকায় যে সব বাঁধ দেয়ার জন্যে টাকা বরাদ্দ হয় তার ৯০ ভাগই নাকি অপচয় হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বল বাঁধগুলো ভেঙ্গে যখন ‘কালো পানি’ এ এলাকায় প্রধান ফসল, হাজার হাজার কোটি টাকার শস্য, মাছ, পাখি ধ্বংস করে নিয়ে যায় তখন ‘হাওয়র উন্নয়ন বোর্ডের’ নয়জন উর্ধতন কর্মচারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নায়াগ্রা’ প্রপাত ভ্রমণে হাওয়া খাচ্ছিলেন। এমন সংবাদ সরকারের ভাবমূর্তিকে দুর্বল করে এবং বিদেশ সফরের যে অপ্রতিরোধ্য হিড়িক শুরু হয়েছে যার ফলে সরকারের সম্পদের বা জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকারই অপচয় হচ্ছে, সে সম্পর্কে সজাগ হওয়া প্রয়োজন বৈকি। বর্তমান সরকার মানুষের প্রত্যাশাকে অনেক অনেক উর্ধে নিয়ে গেছেন এবং এর ফলে মানুষের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সে-সব চাহিদা মেটানোর জন্য সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, দেশের বাজেট দেশের বার্ষিক আয় বা জিডিপির মাত্র ১৪ ভাগ যা নিতান্ত অল্প। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বা অন্যসব ইমারজিং উন্নয়নশীল দেশে এর গড় পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ। তবে সুখের কথা এই যে, ২০০৮-২০০৯ সালে আমাদের দেশে এর পরিমাণ ছিল ১২.৭% ভাগ এবং তা বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টার ফলে ২০১৬-২০১৭ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৭.৪ ভাগে এবং বর্তমান বাজেটে ১৮.৩ ভাগে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন এবং এ কারণেই চার লাখ কোটি টাকার বাজেট গুনতে হচ্ছে। দেশের চাহিদা বিবেচনায় এবং বহুবিদ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে এ বাজেট ৭ লাখ হলেও আকাশকুসুম কিছু নয়; দেশের জিডিপির যদি ৩০% বাজেট পাস করা যেত, তাহলে তা প্রায় ৬-৭ লাখে পৌঁছাত। আমরা যদি ৮-১০ বা ডবল ডিজিট বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই, তাহলে বাজেট আরও বাড়াতে হবে, তার বিকল্প নেই। তাই বাজেটটি বাস্তবায়নযোগ্য, কাল্পনিক নয়। তবে তার জন্যে প্রশাসনিক দক্ষতা যেমন বাড়ানো দরকার, সেই সঙ্গে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাও একান্ত প্রয়োজন। বাজেটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ‘স্বপ্ন পূরণের’ রোডম্যাপ হিসেবে যে সব খাতে অধিকতর বিনিয়োগ দরকার, সে সব খাতে যথার্থভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। যেমন, অবকাঠামো বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার বাবদ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট, হাইওয়ে ইত্যাদি বাবদ প্রায় ৪৮ ভাগ বর্ধিত করা হয়েছে। গেল অর্থ বছরে এ বাবদে বরাদ্দ ছিল ৪১,৮৭৪ কোটি টাকা যা বর্তমান বাজেটে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬২,০১০ কোটি টাকা। তবে সরকারকে এসব বাবদ বাজেট যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তার জন্য কঠোর হতে হবে। নতুবা দুর্নীতির ও স্বজনপ্রীতির কারণে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যাবে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ হচ্ছে এর জনগণ এবং নদী-নালা জলাশয়। বাজেটে মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য যেমন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য খাত ইত্যাদিতে বাজেট রাখা হয়েছে ৪৪,০২৯ কোটি টাকা বা ২৮.৭ ভাগ। যদি এই বরাদ্দকৃত অর্থ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গুণগতমান ও প্রশিক্ষণ না বাড়াতে পারে, তাহলে এর প্রতিফলন উন্নয়নের মহাসড়কে বিড়ম্বনা নিয়ে আসতে পারে। উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সাইবার সিকিউরিটি দক্ষ জনবলের অভাব হেতু আমরা ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে’ হোঁচট খেয়েছি। উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের অভাব হেতু বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে বিদেশী নাগরিকদের চাকরি দিতে হচ্ছে এবং এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ৪/৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪/৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। তবে একথাও তলিয়ে দেখতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত বাজেট যেন গুণগতমান ও উন্নত প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যবহৃত হয়, অপচয় না হয়। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষার সঙ্গে বেকার সমস্যাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে শিল্প কলকারখানা যদি আরও বাড়ে তাহলে বেকার যুবক যুবতীদের চাকরির সংস্থান হয়। এখানে উল্লেখ্য, শুধুমাত্র সরকারের একার প্রচেষ্টায় অধিকতর চাকরির সংস্থান যেমন সম্ভব নয়, একিভাবে শিল্পায়ন ও টিকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব নয়। এজন্যে বেসরকারী বিনিয়োগকে আরও অধিকতর উৎসাহিত করতে হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে এটা সত্য যে, বাংলাদেশে যারা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন তাদের অনেকের আচার আচারণ ও মন-মানসিকতা ব্যবসাবান্ধব নয়Ñ তারা বিনিয়োগকারীদের হরহামেশা হয়রানি করতে ভালবাসেন। এসব ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে একথাও সত্য যে, যারা ব্যবসা করেন তাদের এক বিরাট অংশ নিজের টাকায় নয় বরং সরকারের টাকায়ই ব্যবসা করতে অধিকতর আগ্রহী। তাদের ও মন মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। বাজেটে ভাল মন্দ আছে, তবে ভাল দিকটাই অধিকতর। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এর বাস্তবায়ন এবং এটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে সম্পদের জোগান দান। নতুন ভ্যাট বাদ পড়ায় কিংবা আবগারী শুল্ক বাদ দেয়ায় যে ১৫/২০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হবে, তা কিভাবে পূরণ করা যায়। এ ঘাটতি পূরণ খুব কঠিন নয়। সরকার বাহাদুর সকল সরকারী কর্মচারীর বেতন প্রায় ১০০% বাড়িয়েছেন এবং এমতাবস্থায় আনুষঙ্গিক সুবিধাসমূহ যেমন সরকারী গাড়ি বা জ্বালানি বাবদ অপব্যয় কমানো, স্বর্ণ বা গোল্ড আমদানি লিগেল করে তার ওপর আমদানি শুল্ক ধার্যকরণ, বাড়িঘর, জমিজমা রেজিস্ট্রিকরণ বাবদ দেয় ফিস সোনালী ব্যাংকের মনোপুলি ভেঙ্গে অন্যান্য সরকারী ব্যাংকে জমা দেয়ার রীতি চালু করা, বিদেশে যারা স্বদেশের টাকা পাচার করে বাড়িঘরের মালিক হয়েছেন তাদের ওপর করের বোঝা ও পেনাল্টি ধার্যকরণ, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে জাতীয় লটারি চালু আছে এবং এর মাধ্যমে সেই সব দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অগ্নিনির্বাপণ ও সামাজিক খাতে যথেষ্ট বাজেট দেয়া হয়। বস্তুতঃ লটারি হচ্ছে এক ধরনের ঐচ্ছিক বা ভলান্টারি ট্যাক্স প্রথা এবং অনেক অনেক মুসলিম প্রধান দেশে তা চালু আছে। মোটকথা সরকারী গাড়ি ব্যবহারের অপচয় থেকে ১০/১৫ হাজার কোটি, স্বর্ণের ওপর কর ধার্য করে ২/৩শ’ কোটি টাকা, রেজিস্ট্রিকরণ সহজকরণ বাবদ ১০/১৫ হাজার কোটি, লটারি বাবদ ৫/৭ হাজার কোটি অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ সম্ভব। অনস্বিকার্য যে, সম্পদ বা আয় আহরণের সুযোগ রয়েছে। তবে তা অর্জনের জন্য বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রয়োজন এবং যারা ব্যাংক লুট করে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়েছেন তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা জনকল্যাণে নিয়োগ প্রয়োজন। বাজেট আলোচনায় যারা অর্থমন্ত্রীকে হেয় করার জন্য আদাজল খেয়ে ব্যক্তিভাবে আক্রমণ করেন তাদের জেনে রাখা ভাল যে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয় সহযোগিতায় গত ৮ বছর ধরে প্রমাণ করেছেন যে, তাদের দিকনিদর্শন ও বাজেটসমূহ দেশের জন্য মঙ্গলকর এবং এর ফলে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের জন্য বিশ্ববাসী একে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশ বিস্ময়করভাবে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলসমূহ অর্জন করেছে এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এমনকি দারিদ্রসীমা অর্ধেকের নিচে নামিয়ে এনেছে, মাথা পিছু আয় ২০০৬ সালে যা ৫৭০ মার্কিন ডলার ছিল বর্তমানে তা ১৬০২ ডলারে উন্নীত করেছে, বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২% অতিক্রম করেছে, সব কর্মচারীর বেতন ১০০% বৃদ্ধি করেও মুদ্রাস্ফিতি ও বেকারের সংখ্যা ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে পেরেছে- এগুলো সত্যি অবাক হওয়ার মতই ঘটনা। মনে রাখা দরকার যে, দুনিয়ায় যে সব দেশে প্রবৃদ্ধি ত্বরিতগতিতে বাড়ে সে সব দেশে আয়ের বৈষম্য অত্যাধিক হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বাড়ার সঙ্গেও আয়বৈষম্য ততদূর বাড়েনি। বাংলাদেশে আয় বৈষম্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমুহ যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকেও অনেক কম এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা অনেক অনেক বেড়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী ও সরকারের সুচিন্তিত ও বাস্তবভিত্তিক স্ট্রাটেজি ও বাজেটের রোড ম্যাপের কারণে। যেখানে বাংলাদেশকে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের’ মতো নামী-দামী পত্রিকায় “ঝঃধহফধৎফ ইবধৎবৎ ড়ভ ঃযব ঝড়ঁঃয” বা দক্ষিণ এশিয়ার আদর্শ আখ্যায়িত করে এবং সাম্প্রতিককালে যুক্তরাজ্যের নামী-দামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, “প্রাইস ওয়াটার হাউস” এর মতে বিশ্বে মাত্র তিনটি অর্থনীতি খুব ভাল করছে এবং এদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম তা কি তারা ভুলে গেছেন যে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে হলো। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী যে দেশেই সফরে যাচ্ছেন সেই সব দেশের রাষ্ট্রনায়করা প্রায়শই বাংলাদেশের এই অভাবনীয় সাফল্য কিভাবে সম্ভব হলো তা হরহামেশা জিজ্ঞেস করেন। তবে দুঃখের বিষয় যে, যারা অর্থমন্ত্রীর বয়স এবং প্রজ্ঞার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের কাছে প্রশ্ন তারা কি বাংলাদেশের অর্থনীতির সাফল্যকে সাফল্য মনে করেন না যার জন্য তারা দাবি তুলেছেন ‘অর্থমন্ত্রী বিদায় হন, আপনার বাজেট আর দেখতে চাই না’। মোদ্দাকথা ২০১৭-২০১৮ সালের বাজেটটি স্বপ্ন পূরণের বাজেট। এর দিকনির্দেশনা বা রোডম্যাপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে টিকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধিশালী, স্থিতিশীল, আত্মনির্ভর অর্থনীতি বিনির্মাণের বাজেট। লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি
×