ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

পাহাড় ধস ॥ প্রকৃতির প্রতিশোধ?

প্রকাশিত: ০৩:০১, ২৩ জুন ২০১৭

পাহাড় ধস ॥ প্রকৃতির প্রতিশোধ?

সম্প্রতি চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় যে বিভীষিকাময় দুর্যোগ ঘটে গেল, তা স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের রূপ মাধুর্য আবহমানকালের। পাহাড়, সমুদ্র এবং ঘন বনের নিবিড় সমন্বয়ে বন্দর নগরীর যে নৈসর্গিক বৈভব, তা বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চল থেকে ভিন্নমাত্রার দাবি রাখে। প্রকৃতির অফুরন্ত দানে তার কোলে লালিত মানুষদের জীবনে যে পরম নির্ভরতা আর নিশ্চয়তা এনে দেয়, সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে যখন প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে আঘাত করা হয় তার পরিণাম যে কত নির্মম হতে পারে, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ঘটে যাওয়া এই বীভৎসতা। প্রকৃতি যখন তার নিজস্ব নিয়মে চলে সেখানে মানুষ হয় তার ঘনিষ্ঠ সহচর। প্রয়োজনে তাকে সর্বাত্মকভাবে রক্ষা করতে হয়, সংহত করতে হয় এমনকি তার প্রতি সমস্ত দায়বদ্ধতাও প্রমাণ করা অত্যন্ত জরুরী। এর ব্যত্যয় যে কিভাবে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা সত্যিই অকল্পনীয়। যুগ যুগ ধরে আদিম গুহাবাসী মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেও তার সীমানায় নিজেকে সমর্পণও করেছে। প্রকৃতি অবারিত মুক্ত হস্তে যা দান করত বন্য মানুষরা নির্বিঘেœ, নিশ্চিন্তে তাই গ্রহণে ব্যাপৃত থাকত। তার পরও প্রকৃতি তার নিয়ম অনুযায়ী মাঝে মধ্যে রুষ্ট হতো, আঘাত হানত, গুহাবাসী মানুষরা বিপর্যস্তও হতো। তবে ডারউইনের সেই বিখ্যাত তত্ত্ব ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ায় যারা টিকে থাকার তারাই নিজেদের রক্ষা করতে পারত। সমাজ সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় এক সময় মানুষ সেই প্রকৃতিকে জয় করল, কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করল। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ কখনও করেনি, প্রকৃতির প্রতি নির্মম খ—গহস্ত হয়েও দাঁড়ায়নি। বর্বর কিংবা সদ্য সভ্য হওয়া মানুষদের সে ক্ষমতা এবং সুযোগও ছিল না, হরেক রকম অপকৌশলও ছিল অজ্ঞাত। ফলে প্রকৃতি চলেছে নিজের গতিতে, আপন বৈশিষ্ট্যে। তাই বলে এ কথাও সত্য নয় যে, মানুষ তখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সব সময় রক্ষা পেয়েছে। নিষ্ঠুর প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মকে রোধ করা মানুষের আয়ত্তের বাইরে ছিল। এতো গেল অর্ধ সভ্য, অর্ধ অসভ্য আদিম মানুষের নিত্যদিনের জীবন প্রবাহে প্রকৃতির স্নেহ আর শাসনের এক অমোঘ পরিণতি। কিন্তু সভ্যতার সূর্য যখন সারা বিশ্বময় তার বিকিরণ ছড়াল তখন থেকে শুরু হলো প্রকৃতির ওপর প্রতিশোধের স্পৃহা। স্থান, কাল এবং পাত্র ভেদে এর তারতম্য হলেও প্রকৃতি ঠিক তার নিয়মে আগের মতো সেভাবে চলতে পারেনি। ফলে বিজ্ঞান সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তিকে আয়ত্তে আনার পরও বিপর্যয়কে সেভাবে ঠেকাতে পারেনি। ফলে আজ সারা বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি। আধুনিক শিল্পভিত্তিক যান্ত্রিক সভ্যতাও তার বর্জ্যও আবর্জনায় ভরিয়ে দিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতির যে বেহাল অবস্থা তৈরি করেছে সেখানে সচেতন মানুষের দায়বদ্ধতার ঘাটতি প্রকৃতির ওপর যে বৈরী প্রভাব ফেলছে, তার দায়ভার থেকেও পরিবেশ তার নিজস্ব নিয়ম আর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সঙ্কটাপন্ন। মানুষের সযতœ আর সচেতন মননে তৈরি মানব সভ্যতা যদি তার বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোকে সামাল দিতে না পারে, তাহলে অনাগত ভবিষ্যত আরও ভয়ঙ্কর হতে বেশি সময় নেবে না। মানুষ নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে যে পরিবেশ তৈরি করে, সে আবহ যত নির্মল আর দূষণ মুক্ত হবে, ততই তার অবস্থান সংহত এবং নিরাপদ হবে। পাহাড়, সমুদ্র, আর বন-জঙ্গলের নিরাপদ অভিযোজনে চট্টগ্রামের চিরায়িত সম্ভার এই বিভাগীয় শহরটিকে যে মর্যাদায় নিয়ে গেছে, তা বিশ্ববাসীসহ দেশের মানুষকেও এক অপার আনন্দের খোরাক দিয়ে যাচ্ছে। যে পরিবেশ আনন্দঘন, মুগ্ধতার আর আবেগে আপ্লুত হওয়ার সেখানে কেন এমন বিভীষিকা, মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ আর অগণিত মানুষের প্রাণসংহার? রূপ বৈচিত্র্যের বিভাগীয় এ শহরটির যে মহিমান্বিত মাধুরী, তা আজ কোন সাঁড়াশি আক্রমণে ক্ষত বিক্ষত? রাঙ্গামাটির দুর্গম এবং নিভৃত পাহাড়ী এলাকায় সড়ক বিনির্মাণের দায়বদ্ধতা যাদের ওপর ছিল, তারা ঠা-া মাথায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটতেও দ্বিধা করেনি। যেভাবে সড়কের দু’পাশে কোন নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের কোন সাবধানতাকে আমলে না দিয়ে পাহাড়কে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। যার ফল ভোগ করছে আজ নিরীহ, নির্বিত্ত পাহাড়ী জনসাধারণ। প্রকৃতির ওপর এমন বেপরোয়া আক্রমণ চালাতে গিয়ে প্রকৃতিও হয়েছে ক্ষুব্ধ, নিষ্ঠুর। মানুষ তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার তাগিদে চারপাশে যে বৈষয়িক প্রতিবেশ গড়ে তোলে, সেখানে একটা বিশেষ জায়গাজুড়ে থাকে প্রাকৃতিক সম্পদ। এই ঐশ্বর্য মানুষের প্রতিপক্ষ নয়, তার সহায়ক এবং চালিকাশক্তি। প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা তৈরি করলে প্রকৃতিও নির্মম প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, যাকে ঠেকান সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এখন পর্যন্ত মর্মান্তিক পাহাড়ী ধসকে সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। কবে হবে তা সময়ই বলে দেবে। পাহাড়, সাগর আর বনাঞ্চলে এমন সৌন্দর্যস্নাত রূপময়তা কিভাবে সংহার কার্যক্রমের দিকে এগিয়ে গেল, তার জবাব কি কারও কাছে আছে? এই পাহাড়বাসী অসহায়, বিপর্যস্ত জনগণ কবে স্বস্তি ফিরে পাবে, নিশ্চিন্ত হবে, নিরাপদে বাস করার সুযোগ তৈরি হবে, সেটার কোন ভবিষ্যদ্বাণী কি কারও পক্ষে দেয়া সম্ভব? সবুজ বনাঞ্চলের ওপরও নির্মম ছুরিকাঘাত, বনসম্পদের যে বেহাল অবস্থা, সেখানে প্রকৃতি আজ দেউলিয়া। এই সর্বনাশা এবং স্বার্থান্ধ দুঃসহ অভিযান থেকে বের হতে না পারলে পরিস্থিতি আরও লাগামহীন হতে পারে। প্রকৃতি এবং জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভাবনা নিজস্ব নিয়মে তৈরি হয়, গতিময়তা পায়, সর্বোপরি মানুষ আর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ঋতুবৈচিত্র্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের ষড়ঋতু যে রূপমাধুরী, তাও প্রকৃতির অপরূপ সম্ভার। আর এ দেশের এই অনুপম প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য যুগে যুগে মানুষ আর পরিবেশের সঙ্গে তৈরি করে এক অপূর্ব মেলবন্ধন। যা সৃষ্টিশীল মানুষ থেকে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবন ও কর্মপ্রবাহে যে যুগান্তকারী প্রভাব রেখে, সেটাই এ দেশের চিরায়ত নান্দনিক বৈভব। পারিপার্শ্বিক সর্বজনীনতায় মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে যে সৌহার্দ্য, নিবিড় একাত্মতা গড়ে ওঠে, সেটাই মানুষ আর প্রতিবেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। প্রকৃতি তার নিজস্ব সম্ভার যেভাবে উজাড় করে তার কোলে লালিত সন্তানদের দিয়ে দিয়েছে, সেখানে কোন ধরনের অবিচার, অনিয়ম, আক্রমণ কেন সে মেনে নেবে? সেটাই করা হয়েছে বলে পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ বিরূপ পরিস্থিতি ধারণ করেছে। রুদ্র, রুক্ষ্মমূর্তিতে চারপাশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তার ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়ের জোরালোভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আর প্রকৃতির এই প্রতিশোধে মানুষ আর তার প্রতিবেশ যে পরিমাণ আক্রান্ত এবং বিপর্যস্ত হয়, তার দৃষ্টান্ত তো আমরা বহুবার পেয়েছি। আর চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে যে পরিমাণ পাহাড় ধসের মারাত্মক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ এবং সম্পদহানির মতো দুরবস্থা তৈরি হয়েছে, তা আজও সে অঞ্চলের জনগণকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেভাবে ঘন সবুজ বনকে বৃক্ষনিধন প্রক্রিয়ায় ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়ে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে, তারই পরিণামে আজকের এই ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। শুধুই কি গাছ কেটে বনাঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া? তার ওপর আছে উপর্যুপরি পাহাড়ের মাটি কর্তন করা। পাহাড়ের যে স্বাভাবিক শক্তিময়তা, আপন বৈশিষ্ট্যে দৃঢ়ভাবে টিকে থাকার যে প্রাকৃতিক নিয়মবদ্ধতা, সেখানে মানুষের হিংস্র আঁচড় পাহাড়ের নিজস্ব অবয়বে ফাটল ধরায়। যা ধসের মতো মারাত্মক বিপত্তিকে টেনে নিয়ে আসতে পারে। রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়িতে তাই হয়েছে। মানুষ নিজেই তার স্বার্থান্ধ অভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে বন এবং পাহাড়ের এমন ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে, যার থেকে সে নিজেও রক্ষা পায়নি। এবার যদি আমরা একটু সচেতন হই, যাতে পরিবেশ প্রকৃতিকে তার নিজের নিয়মে চলতে দিতে হবে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হলে সবুজ গাছপালাসহ পাহাড়-পর্বতকেও সযতেœ পরিচর্যা করে তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রকৃতির অবারিত দানের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের শাসন জোরদার করে অবাধ আর মুক্ত প্রকৃতিকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরী। কবি রবীন্দ্রনাথ জীবনভর বাংলার সমৃদ্ধ, সুরম্য প্রকৃতিকে পূজা করেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল দ্যোতনা পূর্ণ হয়েছে প্রকৃতির বন্দনায়। আর মানুষের জীবনযাত্রার সহায়ক, সহযোগী প্রতিবেশকে রবীন্দ্রনাথ বার বার আবাহন করেছেন। শান্তিনিকেতনের নির্মল নৈসর্গিক আবহে তার তৈরি করা শিক্ষাক্রমের পাঠসূচী নির্ধারিত হয়েছে। প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে তাকে জীবনের উপজীব্য করে তার মধ্য থেকে সবটুকু সম্পদ আহরণ করার তাগিদ যেমন নিজের মধ্যে ছিল, একইভাবে তা সর্বসাধারণের কাছেও নিবেদন করার উদাত্ত আহ্বান ছিল বার বার। বিশেষ করে গ্রামবাংলার বৈচিত্র্যিক শ্যামল শোভা শুধু যে তার অনুভবের অনুষঙ্গ হয়েছে তা নয়, বৈষয়িক সম্পদও তাকে বার বার আলোড়িত করেছে। প্রকৃতিগতভাবেই এ দেশের মানুষ কিছু অবারিত বৈভব আর বিত্তের অধিকারী। আর সেটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে প্রকৃতি আর মানুষের যে মিলন সৌধ কবিকে বার বার প্রাণিত করে, তাঁর স্বাক্ষর তার সৃজনশীলতায়, যেমন একইভাবে তার বিশাল কর্মযজ্ঞেও। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে অসংখ্য কবিতা ও গান সমৃদ্ধ হয়ে আছে বাংলার মাটি, বায়ু, জল আর শ্যামল প্রকৃতিতে। শুধু গান কিংবা কবিতাই নয়, মানুষের জীবন ধারণের সবচেয়ে বড় সম্পদ প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সুরক্ষার তাগিদও তিনি দিয়েছেন বার বার। প্রকৃতি মানুষের পরম বন্ধু আর অকৃত্রিম সুহৃদ। তার ওপর অকারণে, অপ্রয়োজনে কোন অবিচার কিংবা আক্রমণ নয়, তাকে নিরাপদে রেখে নিজেদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আরও ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। লেখক : সাংবাদিক
×