ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুঁজিবাজারে টানা পতনের নেপথ্যে ৬ কারণ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

পুঁজিবাজারে টানা পতনের নেপথ্যে ৬ কারণ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রবিবার দেশের পুঁজিবাজার বড় হোঁচট খেয়েছে। এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বৃহত্তর সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৮৩.৪১ পয়েন্ট কমে যায়। এটি গত ৫৪ কার্যদিবসের মধ্যে সবচেয়ে বড় দরপতন। সোমবারও সূচক কিছুটা কমেছে। এছাড়া গত কিছুদিন ধরেই পতনের মধ্যে রয়েছে বাজার। এই পতনে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বেশকিছু কারণেই বাজারেই এই টানা পতন। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, রবিবারের বড় দরপতন আকস্মিকভাবে হয়নি। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নানা কারণে কিছুদিন বাজার নিম্নমুখী থাকায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে গত সপ্তাহে সূচক সাপোর্ট লেভেলের (৫ হাজার ৬০০ পয়েন্ট) নিচে নেমে এলে আস্থার জায়গাটি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। তারপরও অনেক বিনিয়োগকারীর আশা ছিল, সূচক হয়তো ৫ হাজার ৫০০ পয়েন্ট এর নিচে নামবে না। কিন্তু রবিবার লেনদেন শুরুর ১৫ মিনিটের মধ্যে ডিএসইএক্স ২৬ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এলে তাদের শেষ আশার বাতিটাও যেন এক ফুৎকারে নিভে যায়। সূচক আরও কমে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় কার আগে কে শেয়ার বিক্রি করবেন, সবার মধ্যে যেন এমন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিক্রির এই প্রবল চাপে পতন ক্রমেই তীব্র হতে থাকে। মূলধন আটকে যাওয়ায় কমেছে লেনদেন ও আস্থা ॥ প্রায় চার মাসের উর্ধগতির পর চলতি মাসের শুরুর দিকে এসে বাজার তার ছন্দ হারাতে থাকে। বিশেষ করে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লভ্যাংশ ঘোষণা, একটি ব্যাংকের রাইট শেয়ার সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরায়। ব্যাংকের শেয়ারে দরপতন শুরু হলে তাতে বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ আটকে যায়। এতে লেনদেন কমে আসে বাজারে। অন্যদিকে লেনদেন কমে যাওয়ার ঘটনায় ফের আস্থা কমতে থাকে। এভাবে একটি বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করে বাজার। ইসলামী ব্যাংকের কম লভ্যাংশ ঘোষণা ॥ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ওপর বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের আস্থা ছিল। দেশের একটি বড় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ বাজার থেকে শেয়ার কিনে গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে আসবে এমন খবরে গত বছরের জুন থেকে ধীরে ধীরে এর শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। গত জানুয়ারিতে এক মাসে শেয়ারটির দাম ৬০ শতাংশ বেড়ে ৩০ টাকা থেকে ৪৮ টাকা উঠে যায়। এরপর কিছুটা মূল্য সংশোধন হলেও শেয়ারের দাম ৪২ টাকা থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে ওঠানামা করতে থাকে। বাজারে গুজব ছিল ব্যাংকটি ভাল লভ্যাংশ দেবে। গত ৩০ মার্চ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ মাত্র ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। গত এক যুগে ব্যাংকটি এত কম লভ্যাংশ দেয়নি। এতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে আশাহত হয়। ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ারের দামে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ঘটনার দুদিনের মাথায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ৪০ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই খবর আসে ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম বড় স্পন্সর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা আইডিবি তাদের হাতে থাকা ৮ কোটি শেয়ারের মধ্যে ৬ কোটি শেয়ার বিক্রি করে দেবে। এসব ঘটনার সম্মিলিত প্রভাবে বৃহস্পতিবার ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৩১ টাকায় নেমে আসে। এছাড়া সিটি ব্যাংকের লভ্যাংশ কম প্রদান ও আইএফআইসি ব্যাংকের রাইট কেলেঙ্কারিতে বাজারে আস্থা কমে যায়। ব্যাংকের রাইট শেয়ারের রেকর্ড তারিখের ঠিক আগের দিন একজন কথিত বিনিয়োগকারী রাইট প্রস্তাবকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট আবেদন করলে, আদালত তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু চেম্বার জজ হাইকোর্টের নির্দেশ স্থগিত করে দেয়। ডিসেম্বর-ক্লোজিং থেকে জুন-ক্লোজিংয়ে ॥ গত ৩১ ডিসেম্বর তালিকাভুক্ত ব্যাংক, এনবিএফআই ও বিমা কোম্পানিগুলোর হিসাব বছর সমাপ্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের লভ্যাংশ ঘোষণাও শেষ। তাই অনেক বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে ৩০ জুনে হিসাব বছর শেষ হবে এমন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন। এতে ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের শেয়ারে বিক্রির চাপ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে শেয়ারের দরে। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন অনেক বড় বলে শেয়ারের সামান্য দরপতন সূচকে অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে। প্রান্তিক প্রতিবেদনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ ॥ চলতি এপ্রিল মাসে ৩০ মার্চ তারিখে সমাপ্ত প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো। প্রায় সব সময়ই এ প্রতিবেদনকে ঘিরে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। অনেকেই আর্থিক প্রতিবেদন দেখে শেয়ার নির্বাচনের আশায় বিনিয়োগে নিষ্ক্রিয় থেকে অপেক্ষায় থাকেন। বাজারে বিশেষ সাপোর্টের অনুপস্থিতি ॥ যদিও বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ বাজারকে নিজস্ব গতি ও শক্তিতে চলতে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তবু আমাদের বাজারে প্রায়ই এর ব্যত্যয় হয়ে থাকে। দুই মাস আগেও বাজারে বিশেষ সাপোর্ট দেখা গেছে, আইসিবিসহ কিছু অদৃশ্য বিনিয়োগকারীর। কিন্তু এখন সেই সাপোর্ট নেই। বিশেষ মনস্তত্ত্ব ॥ গত বৃহস্পতিবার ডিএসইএক্স তার সাপোর্ট লেভেল ভেঙ্গে ৫ হাজার ৬০০ পয়েন্টের নিচে নেমে আসার পর থেকেই অনেক বিনিয়োগকারী ভাবতে শুরু করেন, পরবর্তী সাপোর্ট লেভেলের আগে বোধহয় পতন থামবে না। ফলে তারা নতুন বিনিয়োগ না করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পথ বেছে নেন। বরং এদের কেউ কেউ ভয়ে উল্টো শেয়ার বিক্রি করেন। আতঙ্কের কিছু নেই ॥ বিশ্লেষকদের মতে, বাজার নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। ইতোমধ্যে যথেষ্ট মূল্য সংশোধন হয়েছে। অন্যদিকে চলতি সপ্তাহের মধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে যাবে। বিনিয়োগকারীরা তাদের কাক্সিক্ষত শেয়ার বাছাই করে বিনিয়োগে সক্রিয় হবেন। সব মিলিয়ে শীঘ্রই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন তারা।
×