ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গভবনের ওয়েবসাইটে ভুলের আছর

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৬ মার্চ ২০১৭

বঙ্গভবনের ওয়েবসাইটে ভুলের আছর

মোরসালিন মিজান ॥ ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা অনেক ঘটেছে। ইতিহাসের প্রতি আছে সীমাহীন উদাসীনতাও। তাই বলে এত উঁচু বিশাল এবং বিস্তৃত দেয়াল টপকে ভুল বলার ভূতটি ঢুকে যাবে বঙ্গভবনে? বাস্তবে ঘটেছে তা-ই। রাষ্ট্রপতির অফিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ অফিসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে দেয়া হচ্ছে ভুল ও বিকৃত তথ্য। বাংলাদেশের সংবিধান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ঘোষণাকে উপেক্ষা করে দেয়া তথ্যে বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি! বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ২৬ মার্চ হলেও বঙ্গভবনের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, এদিন থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের কোন রাষ্ট্রপতি ছিল না! ইন্টারনেটের যুগ হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভুল। গত কয়েক বছরের পুরনো ভুল সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ তো দূরের কথা, এমনকি ভুল দেখার কেউ নেই! সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তথ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে তুলে ধরার মাধ্যমটি ওয়েবসাইট। পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হতে ওয়েবসাইট পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। ডিজিটাল সেøাগানে নতুন শুরু করা বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বেশ এগিয়েছে। এখন সরকারের সব মন্ত্রণালয় দফতর অধিদফতরের রয়েছে স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট। একইভাবে ওয়েবসাইট আছে রাষ্ট্রপতির অফিসের। িি.িনধহমধনযধনধহ.মড়া.নফ -এই ঠিকানায় ক্লিক করলে পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতির সর্বশেষ তথ্য। একই ওয়েবসাইটে দেয়া আছে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সাবেক সকল রাষ্ট্রপতির মেয়াদকালের বর্ণনা। ওয়েবসাইটের হোমপেজে গিয়ে ‘অনারেবল প্রেসিডেন্ট’ লেখাটিতে ক্লিক করলেই আসে কয়েকটি অপশন। সব শেষ অপশনটি ‘ফরমার প্রেসিডেন্টস’। এখানে ক্লিক করলেই পাওয়া যাচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতিদের তথ্য। পাতাটি চোখের সামনে ভেসে ওঠা মাত্রই দৃশ্যমান হচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতিদের ছবি। উপরের দিকে প্রথম ছবিটি যথারীতি শেখ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের। তবে ছবির বাম পাশে যে তথ্য দেয়া তা দেখে চোখ যে কারও কপালে উঠবে। ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি দেখানো হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে! অথচ বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেই নিজেদের নেতা নির্বাচন করেছিল বাঙালী। এর পর ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও এদিন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। সুস্পষ্ট করে একই তথ্য দেয়া হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে সকল সদস্য ১০ এপ্রিলের মধ্যে কলকাতায় মিলিত হন তারা একটি প্রবাসী আইন পরিষদ গঠন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট অক্ষরে বলা হয়েছেÑ ‘... এবং সুনিশ্চিতভাবে ষোষণা করছি ও অঙ্গীকার নিচ্ছি যে, একটি শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই থাকবেন এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি।’ কবে থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন তিনি? এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে ঘোষণাপত্রের শেষ অংশে। বলা হয়েছেÑ ‘আমরা আরও ঘোষণা করছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।’ অর্থাৎ, ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন বলে গণ্য হবে এবং এদিন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় দেশের অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে গণ্য হতো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। পরবর্তীতে এই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে বর্তমান সংবিধানও শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ জন্মের প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রপতির স্বীকৃতি দিচ্ছে। ওয়েবসাইটে ভুল প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য বঙ্গভবনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কাউকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ভুল তথ্যের সূত্র হিসেবে ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নাম। যোগাযোগ করে এই বিভাগেরও কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায়, এমন সহজ সত্য কী করে ভুলে আছে বঙ্গভবন? যখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ সরকারে, যখন মোহাম্মদ আবদুল হামিদের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, তখন শেখ মুজিব সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া কী করে সম্ভব হচ্ছে? এটি ইচ্ছাকৃত ভুল? ইতিহাসের প্রতি অনিহা? নাকি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রশ্নে সাম্প্রতিক সময়ে যে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে, সেটির অংশ? এমন প্রশ্ন তুলছেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধান রচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, সংবিধান প্রণেতা ও বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। এই ব্যাপারে কারও কোন সন্দেহ নেই। বঙ্গভবনের ওয়েবসাইটে যে ভুল সেটি অনিচ্ছাকৃত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে এমন মারাত্মক ভুল কোথাও কারও কাছ থেকেই কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আইনগত দিকগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যটিতে মারাত্মক ভুল রয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কবে থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন সে কথা যেমন বলা আছে তেমনি বলা আছে কবে থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এদিন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আমরা সারা বিশ্বের কাছে এভাবেই তাঁকে উপস্থাপন করেছি। যেখানেই তাঁকে রাখা হোক না কেন, রাষ্ট্রপতির মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছি সবার কাছে। এরপরও রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ভুল তথ্য তুলে ধরায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, আমাদের এখানে ইতিহাস চর্চার সময় লোকের হয় না। রাষ্ট্রপতির অফিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে একটি তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেটি আগে পরীক্ষা করা হচ্ছে না। দ্রুত এই ভুল সংশোধনের দাবি জানান সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও দেশের শীর্ষ এই আইনজীবী।
×